এত বিষ জমেছে সমাজের চাকে?
এত যে রাজনীতি রাজনীতি করি? সমাজের কী অবস্থা? সেটা দেখিয়ে দিলেন রাজধানী ওয়ারীর এক ফ্ল্যাট মালিক। দেখিয়ে দিলেন সমাজ এক সহিংসতার চাক। মৌচাকে মধু জমে, আমাদের এই ‘সামাজিক’ চাকে জমে হিংসার বিষ। মৌমাছি আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে বিষাক্ত হুল, আর মাছি সমাজের জন্য জমায় মধু। আমরা নিজেরা যাচ্ছি রসাতলে আর একে অন্যকে হুল ফোটাচ্ছি।
আলতাফ হোসেনের ভাতিজার গায়ে হলুদ। একে তো তিনি ‘মালিক’ তায় আবার ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক—মস্ত বড় পদাধিকারী! অতএব মধ্যরাত পেরিয়েও সারা পাড়াকে জেগে থাকতে হবে। বাড়ির ছাদে বালাখানা বসানো হয়েছে। কনসার্টের এন্তেজাম, মস্ত বড় সাউন্ড বক্স, বিকট তার আওয়াজ। সেসব হিন্দি গানের রগরগে কথা আর পিলে চমকানো আওয়াজে দুর্বল পিলের মানুষ বেমক্কা হার্টফেল করতে পারে। টর্চার সেলে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে উচ্চআওয়াজ ব্যবহার করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ সরকারি কর্মচারি নাজমুল হকের কাছে আওয়াজটা তেমন অত্যাচার বলেই মনে হয়েছিল। সেই আওয়াজেই সদ্য হার্ট সার্জারি করে আসা মানুষটা মারা যেতে পারতেন। কিন্তু অনুরোধ করে আওয়াজ কমানোয় রাতটা পার হয়।
কিন্তু সকালটা পার হতে পারেনি। হবু বরের চাচা মশায়ের বিরাট অপমান হয়েছে। মস্ত বড় লোক তিনি। মস্ত বড় অর্জন তাঁর এই ফ্ল্যাট মালিকানা। কোথাও কোথাও বাড়ির মালিককে জমিদার বলে। আর ভাড়াটেরা হলেন প্রজা। দেশ থেকে জমিদারি ব্যবস্থা ১৯৫৬ সালে উচ্ছেদ হয়ে গেলেও জমিদারি ভাইরাস অনেকের মধ্যেই রয়ে গেছে। এই মহামান্য আলতাফ হোসেন, অতএব, নিজেকে জমিদারদের নেতাই ভেবেছেন। ভাড়াটেদের তাঁকে ভয় পাওয়াই উচিত। অথচ কিনা, তাঁর বাড়িতে তাঁর ভাতিজার ভয়ংকর গায়ে হলুদের বাদ্যবাজনা থামাতে বলে? রাতে নিশ্চয় তাঁর ভাল ঘুম হয়নি। তিনি সকালের অপেক্ষায় ছিলেন।
সকালে বাড়ির নিচে ‘অপরাধী’দের ডেকে আনেন। তিনি নিজেই বিচারক, তাঁর ভাতিজা-পুত্র ইত্যাদিরা তাঁর লাঠিয়াল-কোতোয়াল। এবং বাংলা সিনেমার মতোই, পুত্রকে বাঁচাতে বৃদ্ধ পিতা আহাজারি করলেন, থামাতে গেলেন এবং মার খেয়ে মরে গেলেন। ব্যস! খেলা শেষ! একটা জীবন শেষ!
আলতাফ হোসেন একা নন। যার যা কিছু আছে তা ফাটিয়ে প্রকাশ করা, যার যতটুকু ক্ষমতা তা অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করাই সামাজিক ইজ্জত বাংলাদেশে। জঙ্গলেও সব প্রাণী যার যার আওতা মেনে চলে, খাবারের দরকার ছাড়া কেউ কারুর গায়ে আঁচড় পর্যন্ত দেয় না। কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা নিম্নগামী। আপনি জাদু জানেন বললেই আপনাকে কেউ জাদুকর বলবে না, জাদুটা করে দেখাতে হবে। তেমনি ক্ষমতা থাকলে তা জাহির করা লাগবে, প্রয়োগ করতে হবে। তবেই না বেশি বেশি সালাম পাবেন।
তাই যাঁর গাড়ি আছে তিনি কানের তালা ফাটানো হর্ন বাজাবেন, যার বাড়ি এবং তালেবর ভাতিজা বা পুত্র-কন্যা আছে, তিনি বাড়ির ছাদে সারারাত কনসার্ট বসাবেন। টাকা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের এটাই এখন ঢাকাই রেওয়াজ। শব্দ সন্ত্রাসও একধরনের বলপ্রয়োগ। শুনতে না চাইলে ভাল কথাও কানের তালা ফাটিয়ে শোনানো উচিত না। তা করাও একধরনের বলপ্রয়োগ। কেননা এতেও দেহ-মন কষ্ট পায়। শিশু, শিক্ষার্থী, অসুস্থ মানুষের জন্য এটা নির্মম অত্যাচারের সমান।
আইন থাকলেও তা মানুষের কাজে আসে না, কাজে আসে অমানুষের। রাষ্ট্র থাকলেও তা জনস্বার্থে উদাস, মুষ্ঠিমেয়র স্বার্থে প্রচণ্ড সজাগ। প্রতিটি মানুষই সমান, প্রতিটি মানুষের অধিকারই পবিত্র। একে রক্ষা করা ও বাড়িয়ে তোলাই রাষ্ট্রের কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু এই সমাজ ও রাষ্ট্রের একক আর ব্যক্তি নয়, বলপ্রয়োগের ক্ষমতাধারীরাই এর একক। রাজনীতিতে এই বলপ্রয়োগের ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিজয় দেখা যায়। রাষ্ট্রের আচরণে দলীয় দাপটেরই অনুকরণ। এর মধ্যে পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার ভয়ে চুপ করে থাকার এক কঠিন অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছি আমরা। প্রতিবাদ করলেই নাজমুল হকের মতো অবস্থা হতে পারে।
সন্ত্রাসীকে বাধা দিলে জীবনের ঝুঁকি। প্রতিবেশীর স্বেচ্ছাচারিতায় আপত্তি করাও জীবনের ঝুঁকি। এ অবস্থায় মানুষ পোকা হয়ে যায়। চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে রাস্তায় ধাওয়া করে কিশোরকে খুন হতে দেখলেও মানুষ উদাস হয়ে থাকে, অন্যায়ের সাক্ষি হলেও মনে হয় দেখে ফেলে ভুল করিনি তো? যখন-তখন সড়ক-মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করলেও মানুষ অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিবাদ না-করাই আত্মরক্ষা। প্রতিটি মানুষকে, ক্ষমতার সিঁড়ির ওপরের মানুষের ইচ্ছার কাছে নত হয়ে চলতে হয়। তার জন্য সহ্যশক্তি বাড়ানো লাগে। একসময় মান-অপমান বোধ অবশ হয়ে যায়। নাগরিকের বদলে তখন আমরা হয়ে উঠি অনুগত প্রজাসমষ্টি। একদিকে অন্যায়ের শিকার, অন্যদিকে অন্যায়কারী আর মাটির ঢেলার মতো নির্জীব দর্শকের এই দেশে ‘মাইরের ওপর জবাব নাই’!
রাষ্ট্রের কথায় পরে আসি; সমাজের কথা হোক। বিয়েবাড়ি আর স্টেডিয়ামের গ্যালারি ছাড়া সামাজিক জমায়েত হয় না। যৌথজীবনে একরকমের ভরসা থাকে, একজনের ডাকে আরেক জন সাড়া দেয়। এখন একের আপত্তিতে আরেকজন দেয় মার। কিছুদিন আগে শহরের সবচেয়ে বড় দুটি শপিং মলে ক্রেতার সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ক্রেতাকে প্রহার করা হয়। বাসাবাড়িতে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী কাজের লোককে প্রহার করে। মসজিদ কমিটি নিয়ে বিবাদে যুবলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলি এবং বরিশালের বাকেরগঞ্জে সালিস বৈঠকে এক ইউপি সদস্যের ঘুষিতে এক ব্যক্তির মৃত্যু আজকের শিরোনাম। গায়ের জোর ছাড়া আমাদের আর কোনো ভাষা নেই। ব্যবসা থেকে প্রেম, ধর্ম থেকে রাজনীতি সবকিছুতেই বলপ্রয়োগের মহৌষধ। কিন্তু মলম দেবে কে?
ফরাসি দার্শনিক ইম্মানুয়েল লেভিনাসের একটা কথা আছে, ভাষাই হলো প্রথম আতিথেয়তা-কেননা কথা চলালে হাত বন্ধ রাখতে হয়। দুই পক্ষে সংলাপ তখনই সম্ভব যখন একে অন্যকে দাম দেই, সম্মান দেই। তাহলে আমাদের বিবাদ-বিতর্কের মীমাংসা আমরা কেন কথা দিয়ে করতে পারি না? কারণ আমরা সামাজিক ভাষা হারিয়ে ভাষাহীন অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। আর ভাষা যখন যোগাযোগ ও সহমর্মিতার বদলে হিংসার অস্ত্র হয়, তখন ন্যায়, যুক্তি ও আশা সব লোপ পেতে থাকে। তখনই মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার বদলে জাগে সন্দেহ-বিরক্তি এবং ভয়। তখনই সাধারণ মানুষও অসাধারণ অন্যায় করে ফেলতে পারে।
হ্যাঁ, ভয়ের শাসনে মানুষ এরকম হয়ে যায়। আলজেরিয়া বিপ্লবী ও মনোদার্শনিক ফ্র্যাঞ্জ ফ্যানো ফরাসি দখলাধীন আলজেরিয়ার গণমানসিকতার মধ্যে ভয়ংকর সহিংসতা জমতে দেখেছিলেন। তিনি দেখান, ফরাসিদের সহিংসতা ও নির্যাতনের দর্পন হয়ে উঠেছে আলজেরিয় মন। অবরূদ্ধ দশায় অবদমনের চাপ সইতে সইতে আলজেরিয়রা নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় মেতে ওঠে। এভাবে তারা চাপ খালাস করে। বাংলাদেশে সম্ভবত আমরা সেই দশায় পৌঁছে গেছি।
ইদানিং রাজনীতি ও রাষ্ট্রকাজ মানে বলপ্রয়োগ। কাজ করিয়ে নিতে ক্ষমতাবানরা দেন হুমকি আর কম-ক্ষমতাধরেরা দেয় ঘুষ। নইলে কোনো কাজই হয় না। দল করা মানে গায়ের জোর, ব্যবসা করা মানে গায়ের জোর, রাস্তাও চলতে হয় একে-ওকে ধাক্কা দিয়ে। কারণ সিস্টেম ভেঙ্গে পড়ছে মানুষের ওপর, তার ধাক্কায় মানুষ পড়ছে আরেক মানুষের ওপর। ভয় ও চাপে থাকা মানুষ ধৈর্য্য হারিয়ে যা কিছু তাই করে ফেলছে। পিতা-মাতা সন্তানকে, সন্তান পিতামাতাকে, ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে, দলীয় সহকর্মী তার সহকর্মীকে খুন করছে।
মানবিকতার এই বিপর্যয় দেখছে না রাজনীতি ও উন্নয়নের মালিকেরা। দেখবেন কীভাবে? নিজ নিজ ঘরানার বাইরে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে তো তাঁরা চলাফেরা করেন না! পরিবেশ দূষণের চাইতে বেশি দূষিত হয়েছে সমাজ, মানুষ, তার মন। শিশুরাও বেড়ে উঠছে এরকম মানসিক জলবায়ুর মধ্যে। আরো ভয়াবহ হলো, সাধারণ মানুষ কিংবা আলতাফ হোসেনদের মতো মানুষ, যাঁরা হয়তো বড় কোনো অন্যায় করতেই চাননি, তাঁরাও রাগ-হিংসার তাপে ভারসাম্য হারিয়ে অমানুষ হয়ে পড়তে পারেন। এ অবস্থায় মানুষই এখন সামাজিক টাইমবোমা—কখন কোন অবস্থায় চাপ পড়লে তা ফুটবে তা কেউ বলতে পারে না।
মানুষে মানুষে সহযোগিতা হলো সমাজের ভিত। ব্যবসা-বাণিজ্য আর ক্ষমতার ভূমিকম্পে রাজনীতির গায়ের জোরের ধাক্কায় সেই ভিত টলে গেছে। একে নতুন করে বাঁধতে হবে, নবায়িত করতে হবে। নৈতিকতা গেল নৈতিকতা গেল বলে হাহাকার করলে এই ভাঙ্গন জোড়া লাগবে না। সবচেয়ে খারাপ মানুষ এবং সবচেয়ে খারাপ মানসিকতা যেভাবে সবার ওপর উঠে পড়েছে তাকে নামানোর চিন্তা করতে হবে। সবচেয়ে ভাল এবং সবচেয়ে যোগ্য সামাজিক ব্যক্তিদের উঠিয়ে দিতে হবে। ডুবন্ত জাহাজের নাবিকেরা সাহায্যের আশায় বার্তা পাঠায় ‘SOS’— সেইভ আওয়ার সোলস; আমাদের জীবন বাঁচাও। আমাদের এখন প্রত্যেকের কাছে এই বার্তাও পাঠাতে হবে যে, ‘সেইভ আওয়ার সোসাইটি’—আমাদের সমাজটাকে বাঁচাও।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
আরও পড়ুন
-
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনেছে: প্রতিমন্ত্রী
-
বগুড়ায় বাইরে সিল মারা ব্যালট বাক্সে ঢোকানোর সময় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও এজেন্ট আটক
-
মুখোমুখি হওয়ার পর কেমন প্রতিক্রিয়া ছিল ট্রাম্প আর পর্ন তারকা স্টর্মির
-
ইমরানের স্ত্রী বুশরাকে বাড়ি থেকে কারাগারে স্থানান্তরের নির্দেশ
-
৪৬তম বিসিএসে ভুল প্রশ্নের জন্য কেউ বঞ্চিত হবেন না, বললেন পিএসসি চেয়ারম্যান