Thank you for trying Sticky AMP!!

এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল

প্রথম আলো ফাইল ছবি

অফিসের একটা কাজে কয়েক দিন আগে বাসে করে গাজীপুর যেতে হয়েছিল। ঢাকা-গাজীপুর রুটে সেটাই নাকি সবচেয়ে ভালো বাস! রাস্তায় যেতে টের পেলাম ভালোর নমুনা। আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একজন তরুণী বাসে উঠে আমার পাশে এসে বসেন। পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমণে টুকটাক কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানতে পারি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজে পড়েন। ঢাকায় বাড়ি। সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসেন। কিন্তু বাসের কথা মনে হলেই তাঁর আসতে ইচ্ছে করে না। বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা একদম অপ্রীতিকর। রাস্তার বেহাল দশা, যানজট--এগুলো তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু বাসচালক, বাসের বেশির ভাগ পুরুষযাত্রী, বাসচালকের সহকারীর বাজে চাহনি, সুযোগ পেলেই শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ-এগুলো মেনে নেওয়া যায় না, সহ্য করাও যায় না। বেশি উচ্চবাচ্য করলে মেয়েটিকেই দোষারোপ করতে থাকে। রুপার ঘটনার পর তো সন্ধ্যা নামলে ভয় করতে থাকে বাসে।

বাসে আলাপ হওয়া ওই তরুণীর কথা ভাবছি গত কয়েক দিন ধরে। আগে মনে করা হতো শিক্ষিত ক্ষমতায়িত মেয়েদের পুরুষেরা ভয় পায়। কিন্তু কীসের কি। এই দেশেই তো প্রতিদিন নারীদের ঘরে-বাইরে সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। যাচ্ছে চলে প্রাণটা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েরা যখন নিজের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ের নির্যাতনের কথা ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ দিয়ে জানান দিচ্ছে, সে সময়ই চোখে পড়ল থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত জরিপটি।

এক কোটির বেশি মানুষের বসবাস এমন ১৯টি শহরে এক জরিপের মাধ্যমে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন এ তালিকা তৈরি করেছে। ৩৮০ জন বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে এ জরিপ করা হয়েছে। যৌন সহিংসতা, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ, ক্ষতিকর সামাজিক চর্চা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে এ অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ শহরের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে আছে ঢাকা। নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানির দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ মহানগরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান চতুর্থ।

নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ শহর মিসরের কায়রো। এরপর যথাক্রমে পাকিস্তানের করাচি, কঙ্গোর কিনশাশা, ভারতের নয়াদিল্লি, পেরুর লিমা, মেক্সিকোর মেক্সিকো সিটি এবং বাংলাদেশের ঢাকা। ঢাকার পরে আছে নাইজেরিয়ার লাগোস, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা এবং তুরস্কের ইস্তাম্বুল। সবচেয়ে ভালো শহরের তালিকাও প্রকাশ করেছে তারা। যুক্তরাজ্যের লন্ডন সবচেয়ে ভালো শহর । দ্বিতীয় জাপানের টোকিও এবং তৃতীয় হয়েছে ফ্রান্সের প্যারিস। জরিপের এই ফল নিয়ে ফেসবুকে একজন নারী মন্তব্য করেছেন এটাই তো প্রত্যাশিত, আরেকজন নারী লিখেছেন, খারাপ শহরের তালিকায় ঢাকা প্রথম হয়নি দেখে অবাক হলাম।

এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকায় এক কোটি আশি লাখেরও বেশি মানুষ। তার অর্ধেক নারী। এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, গণপরিবহনে নারীদের এসব ঝক্কি সামলে তাঁকে প্রতিদিন নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। নারীর ক্ষমতায়নের পথে অনিরাপদ নগর বাধাই বটে। গণপরিবহনে সংরক্ষিত সিট নিয়েও কত কথা। নারী হিসেবে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে-কত কী। ভিড় ঠেলে ওঠা-নামা থেকে সিটে বসা বা দাঁড়িয়ে থাকা-সেখানেও যৌন নিপীড়নের শিকার হননি এমন নারীর সংখ্যা কমই। যানজটে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়, দেখা মেলে না পরিষ্কার কোনো গণশৌচাগারের। ফলে তাঁর প্রস্রাবের রাস্তায় সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে।

ইউএন উইমেন এর নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘সেফ সিটিস ফ্রি অব ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন অ্যান্ড গার্লস ইনিশিয়েটিভ ইন পাবলিক প্লেস’ প্রচারণা মনে করে, সেই শহরই নারীর জন্য নিরাপদ, যেখানে তাঁরা নির্বিঘ্নে যেকোনো সময় সব জায়গায় চলাচল করতে পারবেন, তাঁদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেবে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার। যেখানে কোনো মেয়ে হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হলে অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি পাবে।

আমাদের দেশে পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়ে যতটুকু সচেতনতা বেড়েছে, সর্বসাধারণের চলাচলের স্থানগুলো অর্থাৎ গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র, রাস্তা, পার্ক, গণশৌচাগার নিয়ে ততখানি সচেতনতা বাড়েনি। এসব স্থান এখনো নারীর অনুকূলে নয়।

বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ নারী বাস টার্মিনাল বা রেল স্টেশনের মতো জায়গায় নানা ভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথ এমনিতেই বন্ধুর। পদে পদে এসব হয়রানি সে পথে প্রতিদিন নিত্যনতুন বাধার সৃষ্টি করছে।

অন্তর্জালে দেখি নারীরা পৃথিবীর জয় করে ফেলছেন, আর আমি ঘর থেকে বের হই নানা শঙ্কা নিয়ে।তারপরও আমরা বের হই। নয়তো চলাই থেমে যেত। নারী নিজের তাগিদেই অপরিসীম মনের জোরে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে নামছে। রাষ্ট্র আর কিছু না পারুক অন্তত নারীর নিরাপত্তাটুকু দিক। যাতে নিশ্চিন্তে একজন নারী ঘর থেকে বের হয়ে কোনো রকম হয়রানির শিকার না হয়ে নিজের কাজ সেরে ঘরে ফিরে আসতে পারে।

তৌহিদা শিরোপা: সাংবাদিক