Thank you for trying Sticky AMP!!

এ নির্বাচন দুই পক্ষকে কী বার্তা দিল

বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি প্রজাতন্ত্র, প্রজারাই এ রাষ্ট্রের মালিক

২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিশ্চিতভাবেই ভালো হয়েছে। এতে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল এবং ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতিও ভালোই ছিল। অবশ্য এ নির্বাচন নিশ্চয়ই ২০০৮ সালের মতো ভালো হয়নি, এর আগের তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সঙ্গেও তুলনীয় হবে না। এবারের নির্বাচনের সময় প্রধান বিরোধী দলের নেতা, প্রার্থী ও কর্মীদের অনেকের স্থান হয়েছে কারাগারে, অনেকেই ছিলেন গ্রেপ্তার–আতঙ্কে পলাতক এবং সম্ভাব্য মামলার ভয়ে দৌড়ের ওপর। এসব ঘটনা এবং নির্বাচনের আগের রাতে ও নির্বাচনের দিনে ক্ষমতাসীন দল ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের লক্ষণীয় ব্যাপক তৎপরতাও নিশ্চয় কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তবু পরাজিত পক্ষ যদি এই অভিযোগগুলো তুলে ধরে নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার সম্পূর্ণ উত্তর খুঁজে পেয়েছে মনে করে, তবে সম্ভবত তাদের মূল্যায়ন হবে অসম্পূর্ণ। এর বাইরে আরও কিছু কারণ রয়েছে এবং সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। অন্তত সে পর্যন্ত না এগুলো বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন অর্ধসমাপ্ত থেকে যাবে।

বিজয়ী জোট দ্রুতই সরকার গঠন করতে চলেছে। নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাতে কার্পণ্য করব না। আর সেই সঙ্গে বলব, জয়ী ও পরাজিত উভয় পক্ষের জন্যই এই নির্বাচন থেকে কিছু ভাবনার খোরাক রয়েছে এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার। ২০০৭ সালের এক–এগারোর পরে দৃশ্যত নিরপেক্ষ একটি সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছিল, তাতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, কিন্তু বিএনপি হয়েছিল। তদুপরি বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতার গুরুত্বই প্রধান, সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ঘাটতি ততটা দৃশ্যমান না হলেও বিএনপির রাজনীতি তাকে অস্বীকার ও লঙ্ঘন করেই গড়ে ওঠায় তাদের ব্যত্যয় প্রকটভাবে দৃশ্যমান। তার ওপর হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, সমান্তরাল প্রশাসন চালিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও এ–সংক্রান্ত মামলাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার দায় নিয়ে দলের উদীয়মান কান্ডারি তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবন প্রশ্নবিদ্ধ, এমনকি কলঙ্কিত হয়ে পড়ে।

এর বিপরীতে গত দুই মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকরের পাশাপাশি পাঠ্যবই, গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পুনরুদ্ধার করেছে, জাতির মানসে এর গৌরববোধ ফিরিয়ে এনেছে। সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সংগঠন মিলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও আবেগকে এ সময়ে চাঙা করতে পেরেছে। আমার মনে হয়, ২০১৮ সাল নাগাদ দেশের রাজনীতি অনেকাংশে পঁচাত্তর–পরবর্তী পাকিস্তানবাদী রাজনীতিকে জবাব দিয়ে একাত্তরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। রাজনীতিতে এই যে একটা বাঁকবদল ঘটে গেছে, তাকে বিএনপির নেতৃত্ব যথাযথ গুরুত্ব দেননি। এই পরিবর্তনের আরও প্রমাণ মেলে যখন দেখি এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় বরাবরের মতো ইসলাম বিপন্ন বা ভারতের আগ্রাসনের ধুয়া ওঠেনি। কোথাও এ ধরনের স্লোগান শোনা যায়নি।

শেখ হাসিনাসহ মহাজোটের নেতারা তাঁদের উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর জোর দিয়ে এর ধারাবাহিকতার জন্য ভোট চেয়েছেন। আর বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে ভোট প্রার্থনা করেছে। এতে নির্বাচনটি সরলভাবে উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলেই প্রতিভাত হতে পারে, এমনকি সেভাবেই চিহ্নিত হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য ভালো হবে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে রাজনীতিতে পাকিস্তানবাদকে তামাদি করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনরুজ্জীবনের দিকটির ওপর জোর দিলে।

তবে এই সূত্রেই আরও কথা এসে যাবে। আগে বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু বিগত মেয়াদ এবং সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনকে বিবেচনায় নিলে মানতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শাঁস যে গণতন্ত্র, তার প্রতি সুবিচার হয়নি, হচ্ছে না। যদি এই চেতনার সূচনা ও বিকাশকে পূর্বাপর বিবেচনায় নেওয়া যায়, তাহলে দেখব জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমই এর ভিত্তি ও মূলকথা। কিন্তু সম্ভবত পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনাবলি ও তার পরবর্তী ইতিহাস বিকৃতি, ন্যায়বিচারের পথ রোধ এবং দীর্ঘ একতরফা রাজনৈতিক দমনপীড়নের অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিবেচনায় বৈরী প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পরাস্ত করার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর করেছিল। এটি সম্ভবত তাদের ওপর এতটাই মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করেছিল যে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচনে নতুন প্রজন্ম, নাগরিক সমাজের সমমনা দক্ষ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া এবং নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য রাখার সাহস তারা দেখাতে পারেনি। নির্বাচনের সকল পর্যায়ের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ একটুও হালকা হতে দেয়নি।

গত ১০ বছরে, বিশেষ করে শেষ পাঁচ বছরে সরকার অবকাঠামো, বিদ্যুৎসহ সব ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তার সুফল মানুষ পেতে শুরু করেছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব ও বৈষম্য থাকলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রভাব জনজীবনে অনুভূত হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উদ্যোগী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ বেড়েছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম এবং বয়স্ক ভাতার মতো সরকারি সহায়তা প্রকল্পগুলো দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙার কাজে সহায়ক হয়েছে। তাই বলছিলাম, এটাই ছিল উপযুক্ত সময়, যখন আওয়ামী লীগ অনেকটাই চাপমুক্ত থেকে নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার ঔদার্য প্রদর্শনের ঝুঁকি নিতে পারত। তাহলেই পাকিস্তানবাদী রাজনীতির পক্ষে কোনো অজুহাত থাকত না এবং তার কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠোকা হয়ে যেত। সেই সঙ্গে আমাদের রাজনীতির অনেক কলঙ্কিত চরিত্রেরও রাজনৈতিক আয়ুর সমাপ্তি ঘটত।

এ কথা মানতে হবে, গত ১০ বছরে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে অনেক পরিণত, দক্ষ এবং দূরদর্শী হয়ে উঠেছেন। আপাতত দেশে তাঁর সমকক্ষ রাজনীতিবিদ নেই। এ কথা আলোচিতও হচ্ছে যে তাঁরই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও ক্যারিশমার ওপর নির্ভর করেই আওয়ামী লীগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান তৈরি হয়েছে। নির্বাচনোত্তর অনেক আলোচনা–সমালোচনাও তাঁর পক্ষেই চাপা দেওয়া সম্ভব। এবারে তাঁর কাছে জাতির প্রত্যাশা আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর নেতৃত্বে নতুন সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই গণতন্ত্রের বাতাবরণ আরও মুক্ত ও উদার করবে—সে প্রত্যাশা নিশ্চয় অসংগত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গণতান্ত্রিক আদর্শে থেকেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গনে যদি বিভিন্ন ও বিচিত্র কণ্ঠস্বর সরব না থাকে, আলোচনা ন্যায্য সমালোচনাকে ধারণ না করে, প্রয়োজনে জনগণের অংশীদারত্বের পরিসর ও এর কার্যকারিতা বাড়ানো না যায়, তাহলে সমাজ তো গণতন্ত্রচর্চার জন্য তৈরি হবে না। সরকারও কর্তৃত্ববাদী হতে থাকবে, আর ক্ষমতা ঘিরে পেটোয়া বাহিনীর তৎপরতা ও উৎপাত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।

আমাদের মনে থাকবে অন্তঃকোন্দলে জর্জরিত ছাত্রলীগের ক্যাডাররা শেখ হাসিনার হুঁশিয়ারিকেও গ্রাহ্য করেনি। কর্তৃত্ববাদ, অনুদারতা ও অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির বিপরীতে এখন সচেতন নাগরিক সমাজের মুখ্য দাবি সুশাসন। আমলাতন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা, সামরিক বাহিনী সবাইকে নিজ নিজ চৌহদ্দিতে নিয়মের গণ্ডিতে থেকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়; যার মূলনীতি হলো নিরপেক্ষতা, সমতা ও ন্যায়। বলার ও করার স্বাধীনতা বস্তুত নাগরিকদের অধিকার। তাদের কোনো প্রভু থাকতে পারে না, কারণ বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি প্রজাতন্ত্র, প্রজারাই এ রাষ্ট্রের মালিক। যথার্থ গণতন্ত্র ছাড়া তাদের এ অধিকার নিশ্চিত করা যায় না। দীর্ঘ স্বৈরশাসন কিংবা বিবদমান রাজনীতির টানাপোড়েন এবং গণতান্ত্রিক আমলেও ক্ষমতার কর্তৃত্বপরায়ণতার খেসারত দিয়ে এ দেশের নাগরিক সমাজ দুর্বল, অনেকেই উঞ্ছবৃত্তিতে, কেউবা পক্ষপাতদুষ্টতায় ভোগেন এবং কেউ রীতিমতো স্তাবকে পরিণত হন। মহৎ শাসক নাগরিকদের এহেন হেনস্তার জীবন থেকে মুক্ত রাখেন।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক