Thank you for trying Sticky AMP!!

ওরা কাঁপছে, একটু উষ্ণতা চায়

প্রথম আলো ফাইল ছবি।

রংপুর শহরের উপকণ্ঠে পার্ক মোড় এলাকায় খোকসা ঘাঘট নদের তীরে গত শুক্রবার দুপুরে দেখলাম চারটি শিশু আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছে। শিশু চারটির কারও বয়স পাঁচ-ছয় বছরের বেশি হবে না। তিন-চার বছরের শিশুও সেখানে ছিল। একজনের পায়ে স্যান্ডেলই নেই। ছোট একটি শিশু পাতলা জামা পরে আছে। হাতে দেশলাই। মোজা নেই কারও পায়ে। নিজেরাই খড়কুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনের পাশে বসেছে। রংপুরে তখন তাপমাত্রা প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এ অবস্থা দেখে কবি শামসুর রাহমানের ‘তিনটি বালক’ কবিতার কথা মনে পড়ছে। কবি লিখেছেন, ‘তিনটি বালক যেন নরক পালক, সহযাত্রী/ দুঃখের ভ্রমর-ডিসেম্বরে ফুটপাতে/ কুঁকড়ে থেকে এক কোণে হাড়ে হাড়ে টের পায় যারা/ হিমেল হাওয়ার ধার: শরীরের মাংস যেন খ’সে প’ড়ে যাবে/ ইতস্তত পচা কমলালেবুর মতো নামমাত্র স্পর্শে।’ কবিতার বালকেরাই যেন নেমে এসেছে খোকসা ঘাঘট নদের পাড়ে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি যে এখনো সবার জন্য হয়নি, তা এই চার শিশুর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কবি ষাটের দশকে যে কবিতা লিখেছেন, তা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের সঙ্গেও অনেকটা মিলছে। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে এই অবস্থা। প্রত্যন্ত এলাকার অবস্থা আরও শোচনীয়।

মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া কদিন ধরে ঘরের বাইরে আসছে না। দিনের বেলাতেও অনেক সময় গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। সূর্যও নিরুদ্দেশ। ঘড়ি ছাড়া সময় বোঝার কোনো উপায় নেই। রংপুর-ঢাকা সড়কপথে সাত-আট ঘণ্টার পথ প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগছে। এ অঞ্চলের জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। নদীর পাড়ের ওই চারটি শিশু হয়ে উঠেছে প্রতীকী চরিত্র। শিশু চারটির মাধ্যমে এ অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করা যায়।

১৫-২০ বছর আগে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের শণের ঘর ছিল। শণের ঘরে টিনের ঘরের তুলনায় ঠান্ডা কম লাগত। এখন আর শণের ঘর নেই। জীবনমানের কিছুটা উন্নয়ন আর এনজিওর ঋণে প্রায় সব বাড়িই এখন টিনের। টিনের ঘরে নিচ এবং ওপর দিয়ে হুহু করে কুয়াশা ঘরের ভেতরে ঢোকে। বাইরের ঘন কুয়াশা আর ঘরের ভেতরের ঘন কুয়াশায় কোনো পার্থক্য থাকে না; বরং টিন থেকে টুপ টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা এসব জনপদে শিরশির করে আসা তীব্র ঠান্ডা বাতাস জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। হাড়কাঁপানো এই শীত, বিশেষত অসহায় অসুস্থ বৃদ্ধদের জীবনমরণ সংকটে ফেলেছে।

তাপমাত্রা যখন ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, তখনো কৃষিশ্রমিকদের কাজ করতে হয়। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজেও তাঁদের কাজ চলতে থাকে। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিংবা তার নিচে নেমে এলেও তাঁদের কাজ বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। তাঁদের মাথার ওপর এনজিও কিংবা মহাজনদের ঋণের কিস্তি দেওয়ার চাপও থাকে।

অসহ্য শীতে কৃষিশ্রমিকেরা জলকাদায় পা ডুবিয়ে ধান লাগাচ্ছেন, রবিশস্য উৎপাদন করছেন। শীত নিবারণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় শীতজনিত রোগে ভুগছে অনেকেই। চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য না থাকার কারণে রোগ সারতে দীর্ঘদিন লাগছে।

প্রকৃতিরও কী এক বিচার যে রাষ্ট্র যেসব এলাকায় উন্নয়নমুখী কাজে মনোযোগ দেয় না, সেসব এলাকাতেই ফি-বছর দুর্যোগ নিয়ে হাজির হয়। দেশের সর্বশেষ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালে। সেই তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার ৫টি জেলা রংপুর বিভাগে। এখানেই শীত প্রতিবছর জেঁকে বসে। শৈত্যপ্রবাহ হয় কয়েকবার। দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। সেখানে প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ গরিব। জেলার জনসংখ্যা ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ২১ লাখ। সেই হিসাব অনুযায়ী, জেলায় গরিব মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। যদিও জনসংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। সরকার তো ১ শতাংশ মানুষের পাশেও দাঁড়ায় না। কুড়িগ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে নদ-নদীর সংখ্যা অর্ধশতাধিক। চর আছে পাঁচ শতাধিক। এসব চরের জীবনে শীতে যে অসহ্য যন্ত্রণা নেমে আসে, তা দূর করার মতো পর্যাপ্ত সামর্থ্য তাদের থাকে না। চরজীবনের মানোন্নয়নে যে বিশেষ উদ্যোগ জরুরি, তা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কখনোই আমলে নেননি। ফলে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতে সবচেয়ে বিপদে থাকে চরবাসী। সারা দেশের চরজীবনের প্রায় অভিন্ন চিত্র।

চলতি মাসে জানা গেল, দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। আর হতদরিদ্রের হার নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। এর অর্থ, দেশে এখনো ৫ ভাগের ১ ভাগ মানুষ গরিব। আর ১০ ভাগের ১ ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র। সরকার এই এক-পঞ্চমাংশ মানুষের শীত নিবারণের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অথচ সরকারেরই এগিয়ে আসা উচিত সর্বাগ্রে। গণমানুষের বিপদে সরকারের নীরব থাকার সংস্কৃতি ভাঙা জরুরি।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com