Thank you for trying Sticky AMP!!

ওরা কেন বিদ্যালয়ে যায় না

বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে জীবনমান উন্নত করার অন্যতম প্রধান পথ শিক্ষাবিস্তার। সভ্যতা–সংস্কৃতির কথা যদি না–ও বলি; অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়টাকেই যদি প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখি, তাহলেও শিক্ষার সাহায্যই নিতে হবে সবকিছুর আগে। শিক্ষা ছাড়া বিপুল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করার উপায় নেই। এটা প্রমাণিত হয়েছে জাপানে, দক্ষিণ কোরিয়ায়, চীনে, মালয়েশিয়ায়; ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর কথা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে উৎসাহব্যঞ্জক হারে শিক্ষাবিস্তার ঘটেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে এবং তার ইতিবাচক ফল মাধ্যমিক পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হতে হতে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের একটা অংশ ঝরে পড়ার পরেও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। 

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে দেশের শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অংশটিই এই স্তরের। অদক্ষ শ্রমশক্তির আকার কমিয়ে আধা দক্ষ ও দক্ষ শ্রমশক্তি বাড়ানোর জন্য মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। তা ছাড়া শ্রমবাজারের সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো উচ্চমাধ্যমিক ও তার ওপরের স্তরের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব বাড়ছে, কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছে—এমন জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব দৃশ্যমানভাবে কমে আসছে।

এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সহযোগিতায় সর্বশেষ যে জরিপ চালিয়েছে, তার ফল দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। ইউনিসেফের এই জরিপের ভিত্তিতে তৈরি ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে গড় উপস্থিতির হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীই শ্রেণিকক্ষে নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকছে না। এটা উদ্বেগের বিষয়, কারণ শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতি বা অনিয়মিত উপস্থিতি তাদের ঝরে পড়ার প্রাথমিক লক্ষণ। নবম ও দশম শ্রেণির যেসব শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত উপস্থিত থাকছে না, তাদের একটা বড় অংশই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে না কিংবা অংশ নিলেও উত্তীর্ণ হতে পারবে না—এমন আশঙ্কা প্রকট। তাহলে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার আগেই তারা ঝরে পড়বে এবং সেটা হবে একটা বিরাট অপচয়। বাস্তবে পরিসংখ্যানও বলছে, মাধ্যমিক স্তরেই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। এটা দুঃখজনক, কারণ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একজন শিক্ষার্থীর সামনে যেসব পেশা কিংবা প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, নবম কিংবা দশম শ্রেণিতে ঝরে পড়ে গেল তারা সেসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই তাদের শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতি রোধ করার লক্ষ্যে জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সেটা করতে গেল প্রথমে খতিয়ে দেখতে হবে নবম-দশম শ্রেণির অর্ধেকের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতির কারণগুলো কী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলোর বিশেষত ছেলেসন্তানেরা নবম-দশম শ্রেণিতে ওঠার বয়সে যখন পৌঁছায়, তখন পরিবারের আর্থিক সহযোগিতার জন্য তাদের অনেকে উপার্জনমূলক নানা কাজ শুরু করতে বাধ্য হয়। তাদের অনেকের মা-বাবাও মনে করেন, ছেলের পড়াশোনা যথেষ্ট হয়েছে, এখন তার উপার্জনে নামা উচিত। তাঁদের অনেকের মধ্যে এমন মনোভঙ্গিও কাজ করে যে যেহেতু তাঁরা গরিব, তাই তাঁদের ছেলে লেখাপড়া করে ‘জজ-ব্যারিস্টার’ হবে না। তাঁরা এমন আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চাভিলাষ মনে করেন এবং ভাবেন যে এটা তাঁদের মানায় না।

কিন্তু বিপুলসংখ্যক পরিবারের দারিদ্র্য দূর করা, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। দীর্ঘ মেয়াদে তাদের আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন—এ কথা মনে রেখে তঁাদের সন্তানদের বিদ্যালয়বিমুখতা কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। সরকার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তরে উপবৃত্তির ও দুপুরবেলা তাদের খাবারের ব্যবস্থা (মিড ডে মিল) কোথাও কোথাও চালু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখিতা বেড়েছে। তাঁরা মাধ্যমিক স্তরেও এ মডেল অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন।

নবম-দশম শ্রেণিতে উঠে মেয়েশিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির আরেকটা বড় কারণ বাল্যবিবাহ; দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এ সমস্যা বেশ প্রকট। এটা বন্ধ করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ বাল্যবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ। তবে শুধু আইন প্রয়োগের চেষ্টা সফল হওয়া কঠিন, সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগও নিতে হবে। বিদ্যালয়ের পথে মেয়েশিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ; মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো ও ইভ টিজিং প্রতিরোধকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব, দুর্গম পথ ইত্যাদি সমস্যার কারণেও অনেক অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা কষ্টকর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যয়সাপেক্ষ। এ সমস্যা দূর করার জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের স্থান নির্বাচনে বাস্তবিক প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ভোট আকষর্ণের মতলবে বিদ্যালয় স্থাপন করা চলবে না।

যেসব ছেলেমেয়ে নবম–দশম শ্রেণিতে উঠে দারিদ্র্যসহ নানা কারণে আর বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। এটাও কম গুরুতর কথা নয়। এই দুঃখের প্রতিকারের উদ্যোগ অবশ্যই নেওয়া প্রয়োজন।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
mashiul.alam@gmail.com