Thank you for trying Sticky AMP!!

কক্সবাজার ঘোষণা, ভারতের টনক নড়ুক

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা বসতি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা লিখিতভাবে এত সোজাসুজি এর আগে কেউ বলেছেন কি না, জানা নেই। তবে কক্সবাজারে যা হলো, তাকে অভিনব বলা যেতে পারে।

নভেম্বরের প্রথম দুই দিন কক্সবাজার শহর ছাড়িয়ে বহু দূরে নিরিবিলি প্রকৃতির কোলে বাংলাদেশ-ভারত নবম মৈত্রী আলোচনায় বড় হয়ে উঠে এল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চোরা স্রোত, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অচিরেই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এবং, সম্ভবত এই প্রথম আলোচনাকারীদের মধ্য থেকে স্পষ্ট ভাষায় সেই উদ্বেগের কথা লিখিতভাবে পরিবেশিত হলো, যা ভারতীয় শাসক দলের নেতাদের কাছে বিশেষ অর্থবহ হওয়া উচিত। কতটা হবে তা অবশ্যই অনুমানসাপেক্ষ। তবে এটুকু পরিষ্কার, বাংলাদেশের ভয় ও আশঙ্কার কথাটা এমন খোলামেলা উপস্থাপন হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন নিশ্চিতই ছিল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের খাতিরে যে কথা সরকারের পক্ষে বলে ওঠা হয় না, কূটনীতির বেসরকারি আঙিনায় তা অন্যভাবে উচ্চারিত হয়। ‘ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির’ কাজই তা।

এই দুই দেশের তো বটেই, উপমহাদেশের নিরাপত্তা আগামী দিনে কতটা টান টান থাকবে অথবা ধরে রাখা সম্ভব হবে, তার চাবিকাঠি রয়েছে এই কক্সবাজারেরই। যেখানে দুই দিনের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, সেখান থেকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আবাস মাত্রই এক ঘণ্টার পথ। দশ–এগারো লাখ রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী-শিশুর প্রতি মানবিক হতে একটা সরকারের কী কী করা দরকার, না দেখলে তা বোঝা অসম্ভব। বাসস্থান, পরিধান, খাদ্য, পানীয় ও সেই সঙ্গে শিক্ষাদান কতগুলো রাজসূয় যজ্ঞের সমতুল তা অনুমান করাও কঠিন। এই কাঠিন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও এক কঠিন সত্য, যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঝলমলে শিরস্ত্রাণের সবচেয়ে উজ্জ্বল পালকগুলোর একটা। ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে সামলেও ৮ শতাংশের বেশি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা কী করে সম্ভব, কী করে এই প্রতিকূলতা সামলে মানব উন্নয়ন সূচকে ওপরের দিকে অবস্থান আদায় করা যেতে পারে, ভারত তো বটেই, বিশ্বেও এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।

কিন্তু এসবই ফুৎকারে মিলিয়ে যেতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বাধাগুলো যদি দ্রুত কাটানো না যায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তাই এই সম্মেলনে এই প্রথমবার সরাসরি বললেন, মিয়ানমারকে রাজি করাতে ভারতকে এবার চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অনুরোধ, উপরোধ, সচেষ্ট হওয়ার মতো মিইয়ে থাকা শব্দ ব্যবহার না করে চাপ সৃষ্টির কথা এই প্রথম উচ্চারিত হলো। এবং সেটাও তিনি করলেন ভারতের নীতিনির্ধারক, সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিক এবং ‘থিঙ্কট্যাংকের’ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে।

পরের দিনই খবর এল, থাইল্যান্ডে ১৬ দেশের নেতাদের উপস্থিতিতে রিজিওনাল কম্প্রিহেনশন ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা ‘আরসেপ’–এর আসরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে এই প্রয়োজনীয়তার কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোরের সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন। ভারতের দিক থেকে সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধব, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক অলোক বনসল, সাংসদ এম জে আকবর, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাস, সাবেক কূটনীতিক বীণা সিক্রি ও প্রিয়া শরণ, আসামের অর্থমন্ত্রী এনআরসির প্রবল সমর্থক হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের শ্রীরাধা দত্ত ও অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক জয়িতা ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও তাঁর ডেপুটি শাহরিয়ার আলম, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে বিভিন্ন থিঙ্কট্যাংকের সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের উপস্থিত করিয়ে ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক এ এস এম সামসুল আরেফিন যতটা তাক লাগিয়েছেন, ঠিক ততটাই চমকপ্রদ নিরাপত্তার প্রশ্নে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মহম্মদ আলী শিকদারের হুঁশিয়ারি। কোনো ভণিতা না করেই তিনি জানিয়ে দেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গা অনির্দিষ্টকাল ধরে বাংলাদেশে থাকলে তাদের ঘরে ঘরে মানববোমা জন্ম নেবে। সন্ত্রাসবাদের ছোবল থেকে বাংলাদেশ তো বটেই, এই তল্লাট বাঁচতে পারবে না।

কিন্তু শুধু রোহিঙ্গাই একমাত্র সমস্যা নয়। তাঁর কথায়, দুই দেশের সম্পর্কে ক্রমে কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারতীয় নেতাদের চূড়ান্ত ধর্মীয় মন্তব্য, বছরের পর বছর ধরে তিস্তা চুক্তির ঝুলে থাকা, এনআরসি এবং কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অবলুপ্তি। এনআরসিকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে উল্লেখ করেও তিনি সরাসরি জানাতে দ্বিধা করেননি, ভারতীয় শাসক দলের নেতাদের সাম্প্রদায়িক ভাষার ব্যবহার বাংলাদেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক মানুষকেও বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে। সাবধান করে দিয়ে তিনি জানান, পৃথিবীর বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে ভারত বিরাট একটা ঝুঁকি নিয়েছে। সন্ত্রাসীরা এর সুযোগ নিতে ছাড়বে না।

তিস্তার পানি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কারও জানা নেই। শিরীন শারমিন চৌধুরীর আক্ষেপ, এত কিছুর পরও তিস্তা অধরা থেকে যাচ্ছে। শাহরিয়ার আলমের কণ্ঠেও সেই এক বেদনার সুর। এত বছর ধরে তিস্তা ঝুলে থাকার পর এখন অন্য নদীগুলোর অববাহিকা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তিস্তা জুড়ে গেছে। এটাও কতকাল ঝুলে থাকবে অজানা। তিস্তা যেন কাকস্য পরিবেদনা!

সম্পর্কের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চতাও। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল এলাকাগুলো এখনো আঁধার কাটাতে পারছে না। জনপ্রিয়তা ধরে রেখে অগ্রগতি করতে গেলে কী কী করণীয়, কক্সবাজার তা আরও একবার দেখিয়ে দিল। বল আগেও ভারতের কোর্টে ছিল, এখনো রইল। তারাই বড় তরফ। শুধু ‘সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের ন্যায়’।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি