Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনাভাইরাস মোকাবিলা দরকার সব ক্ষেত্রে সমন্বয়

ত্রাণ তৎপরতা চালাতে হবে সামাজিক দূরত্ব মেনে

করোনা নামক প্রাণঘাতী একটি ভাইরাস তিন মাসের বেশি সময় ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এর সরাসরি কোনো চিকিৎসা নেই। গেল বছরের শেষ দিকে চীনের উহান শহরে প্রথম এর যে সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল, তাতে সেখানে প্রাণহানি হয় 

তিন হাজারের বেশি। এই সংক্রমণ এখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সংক্রমিত হয়েছে ১৭ লাখের বেশি মানুষ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াও এর বাইরে নেই। দেশে এ পর্যন্ত ৬২১ জনের সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে। মারা গেছেন ৩৪ জন।

বাংলাদেশে শুরুতে এটি নিয়ে তেমন প্রস্তুতি না থাকলেও এখন বিভিন্ন তৎপরতা চলছে ও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি পীড়াদায়ক। যেগুলো সহজেই এড়ানো যেত। একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস এ পৃথিবীর মানবকুলকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। তবে মানুষ অসহায় আত্মসমর্পণ না করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যার যেটুকু সামর্থ্য আছে, তাই নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। তবে এ লড়াই বহুমাত্রিক। রাষ্ট্রীয় ও অ–রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের এর সঙ্গে যুক্ততা রয়েছে। কাজগুলোও বেশ কিছু ক্ষেত্রে অভিন্ন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা নিবিড় সমন্বয় থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে বিপরীত ফল দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

যেমন শুধু একটি ক্ষেত্রে একধরনের সমন্বয়ের অভাবে কয়েক হাজার পোশাকশ্রমিক রাতারাতি দূরদূরান্ত থেকে ঢাকার সন্নিহিত শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলে এসেছিলেন। তাঁদের দৈহিক পরিশ্রম হয়েছে। গচ্চা গেছে টাকা। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। ঠিক তেমনি সংকটের সূচনায় করোনা সংক্রমিত দেশগুলো থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে চলে আসেন। বিমানবন্দরে তঁাদের মামুলি ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এবং কোথায় অবস্থান করবেন তার যথাযথ ঠিকানা না রেখে হোম কোয়ারেন্টিনের পরামর্শ দিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়। সেসব ব্যক্তির হদিস করতে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ গলদঘর্ম হয়েছে। আন্তবিভাগীয় সমন্বয় থাকলে এমনটা হতো না। এই প্রবাসীদের বা বিদেশ থেকে আসা কারও কারও মাধ্যমেই ভাইরাসটি দেশে প্রবেশ করেছে। তাঁরা সংক্রমিত করেছেন তঁাদের সংস্পর্শে আসা লোকজন বা স্বজনদের।

সংক্রমিতদের চিকিৎসার দায়িত্ব ডাক্তার ও তাঁদের সহযোগীদের। শুরুতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জামের (পিপিই) ঘাটতির অভিযোগ শোনা গেছে। তবে পরে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দেওয়া গেছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে এখন দেশে পিপিই সংকট নেই। তবে হোম কোয়ারেন্টিন এবং পরবর্তীকালে লকডাউন সময়কালে ঘরে থাকার বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসে। এটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি, তা সুস্পষ্ট। বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও এই কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একটি বিষয়ে এখনো সমস্যা থেকে যাচ্ছে, তা হচ্ছে কারও মধ্যে করোনা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে তিনি কীভাবে চিকিৎসা সহায়তা চাইবেন। জনগণের মধ্যে এ ব্যাপারে যেমন সচেতনতার অভাব আছে, তেমনি সংক্রমিত হিসেবে সন্দেহভাজন অনেককে এ ক্ষেত্রে নানা ঝক্কিঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তা ছাড়া করোনা আক্রান্তের সুস্পষ্ট লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ তা লুকাচ্ছেন এবং জানাতে চাচ্ছেন না। করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়া কোনো অপরাধ নয়। বরং এটা গোপন রাখলে নিজের পাশাপাশি স্বজন ও পড়শিদের বিপন্ন করবেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করতে পারে।

অবশ্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার অনেক রীতিনীতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন ও জানাজা সরকারি উদ্যোগেই হয়। স্বজনদের উপস্থিতির সুযোগও সেখানে কম। সামাজিক কবরস্থানে দাফনে টাকা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এগুলো স্থানীয় সরকারগুলোর নেতাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লকডাউনকালে সবাইকে সব সময় ঘরের মধ্যে থাকতে হবে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের কেউ কেউ ধরে নিতে পারেন। এটা মোটাদাগে সঠিক। তবে কৃষিকাজের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁরা এর আওতায় আসেন না। আর কয়েক দিনের মধ্যেই হাওর অঞ্চলে ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। প্রকৃত সহায় থাকলে এ অঞ্চল থেকেই আমাদের চালপ্রাপ্তির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টন। মালিক–শ্রমিক সবাই উৎসবের আমেজে ধান কাটবেন ও করবেন প্রক্রিয়াজাত। এ মাসে বহিরাগত শ্রমিকদের কাজের ক্ষতি না করে মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারেন।

লকডাউন স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। প্রায় ৫০০ প্রাণহানির পরও সুইডেন লকডাউন করেনি এবং বলেছে তারা তা করবে না। অথচ আমরা ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। আমাদের এর বিকল্প ছিল না। তবে বিভিন্ন ব্যবস্থাগুলোকে কবে, কখন ও কোন পরিস্থিতিতে আবার চালু করা হবে, তার একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ রাখার ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করার সুযোগ নেই। অনেক দেশে যখন করোনার রেশ থেমে যাবে, তখন সেসব দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের এবং প্রবাসীদের আমরা কীভাবে কোয়ারেন্টিন করব, সেসব বিষয় আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে।

অর্থনীতির চাকা আবার সচল করতে সময় নেবে। ইতিমধ্যে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে, তা সামাল দিতে বহু সময় লাগবে। কোন খাতে কীভাবে কাজ করতে হবে, এ নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ চলছে এখনই। জনগণের কর্মসংস্থান হয় এখানেই। এর তিনটি প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি, শিল্প ও সেবা। লকডাউনে শিল্পের উৎপাদন প্রায় থেমে গেছে। সেবা খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ দুই ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রবাসী আয়ে এমনিতেই একটি দীর্ঘ নেতিবাচক ধারা চলছিল। সেটা করোনা ও তেলের মূল্য অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কারণে আরও প্রলম্বিত হতে পারে। এই ক্ষতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা এখন থেকেই ভাবতে হবে।

অর্থনীতিতে সদা চলমান এমনকি ক্রমবর্ধিষ্ণু আমাদের কৃষি খাত। জিডিপিতে এর অবদান যত কমই হোক, প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান হয় এই খাতেই। খাদ্যশস্য, শাকসবজি উৎপাদন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও ডিম উৎপাদন অনেকটা সময় মেনে চলে। এমনিতেই দীর্ঘস্থায়ী লকডাউন, পরিবহন ও বাজারব্যবস্থায় অস্থিরতা ও ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে। এটার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থাকে সংকটাপন্ন করবে। একে চাঙা রাখতে হলে এর উৎপাদন ও বিপণনপ্রক্রিয়ার যেকোনো প্রতিবন্ধকতা দূর করা দরকার। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করেই এসব পণ্যের পাইকারি ও খুচরা লেনদেনের সময়সীমার বিষয়ে উদার হতে হবে। তেমনি ভোক্তারা যাতে কেনাকাটা করতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাতে জনগণ খুব সমস্যায় না পড়ে।

পরিশেষে থাকছে সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ ও খাদ্য বিপণনব্যবস্থা। সরকার যতটা সম্ভব উদারভাবে ১০ টাকা কেজিতে ওএমএস চাল দিচ্ছে। আর টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্য দামে বিক্রি করছে কিছু অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী। বিক্রি ব্যবস্থায় মহানগরগুলোতে সমন্বয়ের অভাব লক্ষণীয়। কর্মহীন হাজার হাজার মানুষ এগুলোর অপেক্ষায় থাকেন। অথচ আগে তাঁরা থাকতেন কাজে। সরকারের সরবরাহ যেহেতু অফুরান নয়, তাই দৈহিকভাবে যারা অধিকতর শক্তিশালী, তারাই এর সুফল নিতে পারে। ট্রাক এলেই তারা পড়ে ঝাঁপিয়ে। বেসরকারি ত্রাণ বিতরণের কোনো নিয়মনীতি বা সমন্বয় নেই। কেউ তিনবার পায়, আর কেউবা পায় না।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কার্যালয়গুলোকে কাজে লাগানো যায়। সেখানে এলাকাওয়ারি তালিকা তৈরি করে রাখা অসম্ভব কাজ নয়। গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদ করছে। ভুলভ্রান্তি ও দুর্নীতি আছে। কঠোর তদারকি থাকলে সেটা কমানো সম্ভব। তেমনটা করা যায় মহানগরীতেও। কোনো ভিত্তি ছাড়া যে চাইল তাকেই দিলাম, এভাবে দীর্ঘ সময় চলতে পারে না। অথচ সরকারের ত্রাণ অনেক ক্ষেত্রেই এভাবে বিতরণ করা হচ্ছে।

সব ক্ষেত্রে সমন্বয় ছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের জন্য কঠিন হবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com