Thank you for trying Sticky AMP!!

কারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ

কিছুদিনের মধ্যে অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে এই ১০ জন থেকে পাঁচজনকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। কমিটি ইতিমধ্যে কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির কাছ থেকে কমিশনার হিসেবে তিন শতাধিক নাম পেয়েছে। বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ কিছু দল এ থেকে বিরত থাকার কারণে প্রস্তাবিত নামগুলো কিছুটা একপেশে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিছু নাম নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কও তৈরি হয়েছে।

অনুসন্ধান কমিটি এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রায় অর্ধশত নাগরিকের সঙ্গে পরামর্শমূলক বৈঠক করেছে। সম্ভবত বিতর্ক এড়ানোর জন্যই এসব বৈঠকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাদে অন্য কেউ কমিশনার হিসেবে কারও নাম প্রস্তাব করেননি। তাঁরা বলেছেন কমিশনার হিসেবে বাছাই করার ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মানদণ্ডের কথা।

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ-সম্পর্কিত ২০২২ সালের আইনেও এমন যোগ্যতা ও অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। মূলত, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সেখানে বলা হয়েছে পাগল, দেউলিয়া, ফৌজদারি বা যুদ্ধাপরাধ আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনার পদে অযোগ্য হবেন। এসব অযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। তবে অনুসন্ধান কমিটি যে তিন শতাধিক নাম পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে খুব সম্ভবত পাগল, দেউলিয়া বা দণ্ডিত কেউ নেই। কমিটির কাছে তাই চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এসব ব্যক্তির (এবং তালিকার বাইরেও যাঁদের নাম কমিশন নিজ বিবেচনায় বিচার্য মনে করতে পারে তাঁদের) মধ্য থেকে ১০ জনকে বাছাই করার প্রক্রিয়া নিয়ে।

২০২২ সালের আইনে এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতির উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আইনটির ৪ ধারায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে কমিটিকে কাজ করতে বলা হয়েছে। আবার নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অযোগ্যতার পাশাপাশি সুনাম ও সততার কথা বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।

অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে আলোচনাকালে এসব নীতি অনুসরণ করার লক্ষ্যে আমি কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি। যেমন নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করলে যাঁরা বিভিন্ন সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধা বা অনুগ্রহ (যেমন অন্যদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি, চাকরিতে এক্সটেনশন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ) পেয়েছেন, পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন বলে তাঁদের বাদ দিতে বলেছি। সুনাম ও সততা বিবেচনায় নিলে যাঁরা দায়িত্ব পালনকালে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম বা দুর্নীতি করেছেন, তাঁদের বাদ দেওয়া যায়, বলেছি।

কমিটির সঙ্গে আলোচনাকালে আরও কেউ কেউ এসব কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে কি নেই, কয়েকজন সে ভিত্তিতে কমিশনার নিয়োগের কথাও বলেছেন। কারও সেই চেতনা আছে কি না, তা আমরা কীভাবে বুঝব, সেটি অবশ্য কেউ বলেননি।

২.

প্রথমেই বলে রাখি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোক বাছাই করা একটি উত্তম প্রস্তাব। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী, আগে সেটি উপলব্ধি করতে হবে।

২০২২ সালের আইনে এ ব্যাখ্যা নেই। তবে বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কী বোঝায়, তা বলা আছে। সে অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই মহান আদর্শগুলো। অন্য অনেক খারাপ বিধান থাকলেও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের এই সংজ্ঞা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে এসব আদর্শকে শুধু সংবিধানের মূলনীতি নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। এসব মূলনীতির মানদণ্ডে নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করা হলে তার চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না।

কাজটি কঠিন নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানেই এসব মূলনীতির ব্যাখ্যা রয়েছে। সেখানে যেসব মূলনীতি রয়েছে, তার মধ্যে নির্বাচন বিষয়ে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে গণতন্ত্র। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র বলতে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। গণপরিষদ বিতর্ককালে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা জোর দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। সে অনুসারে জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও ভুয়া নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।

১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র বলতে এমন একটি ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। ফলে নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার (যেমন ৩১, ৩২, ৩৫) পরিপন্থী বলে এগুলো অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যারা ভুয়া নির্বাচন আয়োজন বা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বা যারা প্রকাশ্যে এর পক্ষ গ্রহণকারী, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে নির্বাচন কমিশনার পদে বিবেচনা থেকে তাই বাদ দেওয়া উচিত।

মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি মহান আদর্শ সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে সমাজতন্ত্র বলতে শোষণমুক্ত, ন্যায়ানুগ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ১০), উৎপাদনযন্ত্র, ব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালির ওপর জনগণের মালিকানা (১৩), জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করা (১৬), অনুপার্জিত (অর্থাৎ দুর্নীতি বা অনিয়মের মাধ্যমে) আয় ভোগ করার অবসান ঘটানো (২০) ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। সে অনুসারে শোষণ ও বৈষম্যমূলক আইন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দুর্নীতি এবং অবাধ ও দায়মুক্তিমূলক বেসরকারীকরণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।

ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ (অনুচ্ছেদ ১২) অনুসারে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু ধর্মের কোনো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য ও নিপীড়ন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ও কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যেমন যারা রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে ঢুকিয়েছে বা যারা বহাল রেখেছে, তারা প্রত্যেকেই চেতনাবিরোধী কাজ করেছে।

Also Read: অনুসন্ধান কমিটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি করতে পারবে না

অপর মূলনীতি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি, যার বলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে। সে অনুসারে এই সংহতিবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।

সংক্ষেপে বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা জনগণের অবাধ ভোটাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার, শোষণমুক্ত, দুর্নীতিহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজে বিশ্বাস করেন, যাঁরা জাতীয় ঐক্য এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন, যাঁদের কথা-কাজে এর কোনো ব্যত্যয় লক্ষ করা যায় না। এমন কোনো ব্যক্তির ২০২২ সালে আইন মোতাবেক নিরপেক্ষ, সৎ ও সুনামসম্পন্নও হওয়ার কথা। এমন মানুষদের যদি অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে খুঁজে পায়, তাহলে তা দেশের জন্য পরম কল্যাণ বয়ে আনবে।

৩.

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের কমিটমেন্ট রয়েছে, এমন লোককে খুঁজে বের করতে হলে অনুসন্ধান কমিটিকে স্বচ্ছতার নীতিও অবলম্বন করতে হবে। এ নীতির কেবল আংশিক প্রতিফলন ঘটেছে কমিশনার পদে প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশের মাধ্যমে। এ নামগুলো কারা দিয়েছেন, তা প্রকাশ করা হলে বাছাই করার মানদণ্ডগুলো কতটুকু প্রয়োগ করা হয়েছে, তা আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম। এখনো এটি করার সুযোগ রয়েছে।

স্বচ্ছতার স্বার্থে আগামী দিনে যে ১০ জনকে কমিটি বাছাই করবে বা যাঁদের বাদ দেবে, তার কারণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা জনগণকে জানানো উচিত। অনুসন্ধান কমিটি এটি করবে বলে আশা করছি।

উপযুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠন সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি প্রাথমিক শর্ত। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে এ জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো ঠিক করা। প্রথমেই আমরা হোঁচট খেলে পরের কাজটি আরও দুরূহ হয়ে পড়বে।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক