Thank you for trying Sticky AMP!!

কার্ল মার্ক্স কি এখনো প্রাসঙ্গিক?

অনেক দেশেই কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হয়েছে

চীনের গৃহযুদ্ধে মাও সে-তুংয়ের কমিউনিস্ট বাহিনী ১৯৪৯ সালে জয়ী হওয়ার ৪০ পর বার্লিন দেয়াল ভাঙা পর্যন্ত কার্ল মার্ক্সের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল অলঙ্ঘ্যেয়। পৃথিবীর প্রতি দশজনের প্রায় চারজনই এমন সরকারগুলোর অধীনে ছিল যে সরকারগুলো নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে দাবি করত। এর বাইরে বহু দেশে বামপন্থীদের অনুকরণীয় আদর্শ ছিল মার্ক্সবাদ এবং মার্ক্সবাদকে কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটিই ছিল সেসব দেশের ডানপন্থীদের মূলনীতি।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার পরও সেখানে মার্ক্সের প্রভাব রয়ে যায়। ১৮১৮ সালের ৫ মে মার্ক্সের জন্ম হয়। চলতি মাসে তাঁর জন্মের ২০০ বছর পূর্ণ হলো। এই এত দিন পরও এটি বলা মোটেও ঠিক হবে না যে, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ভুল ছিল; তাঁর তত্ত্ব আস্থা হারিয়েছে বা একেবারে সেকেলে হয়ে গেছে। তাহলে আমাদের সামনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই একুশ শতকে এসে তাঁর তত্ত্বের উত্তরাধিকারকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে দাবি করা শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে উৎপীড়কের ভূমিকা নিয়ে মার্ক্সের সুখ্যাতিকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন; যদিও মার্ক্স নিজে কখনো এসব অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়ার কথা বলেছেন বলে কোথাও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সোভিয়েত ব্লক এবং মাও-শাসিত চীনে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার মূল কারণ হলো সেখানকার সরকার জনগণকে মানসম্মত জীবনব্যবস্থা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে টেক্কা দিতে পারার মতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তারা গড়তে পারেনি।

এই ব্যর্থতাকে মার্ক্সের দেওয়া সমাজতন্ত্রের নকশার ত্রুটি বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না, কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে পরিচালিত হবে, মার্ক্স কস্মিনকালেও সেই পথ বাতলে দেওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। আমাদের বরং সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণকে আরও গভীর ত্রুটির মধ্যে তলিয়ে দেখতে হবে। এই গভীর ত্রুটি হলো, মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্ক্সের ভ্রান্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।

মার্ক্স মনে করতেন, বংশগত বা মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাবের মতো আর কিছু নেই। ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভে তিনি লিখেছেন, ‘সামাজিক সম্পর্কগুলোর যূথবদ্ধতাই মনুষ্যচরিত্রের সার।’ পরে তিনি বলছেন, ধরা যাক, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে ফেলার মাধ্যমে আপনি সামাজিক সম্পর্কগুলো পাল্টে দিলেন এবং পুঁজিবাদী ও শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বিলুপ্ত করে দিলেন; তাহলে দেখা যাবে পুঁজিবাদী সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষের চেয়ে এই নতুন সমাজের মানুষ একেবারে আলাদা ধরনের হয়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে থাকা মনুষ্য-প্রকৃতির ওপর বিশদ পড়াশোনা করে মার্ক্স এমন সিদ্ধান্তে এসেছেন বলে মনে হয় না। বরং তিনি ইতিহাস সম্পর্কে হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গিকেই এখানে প্রয়োগ করেছেন। হেগেলের মতে, মনুষ্য-চেতনার মুক্তিই ইতিহাসের অভীষ্ট লক্ষ্য। তিনি মনে করতেন, যখন আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারব যে আমরা বিশ্বজনীন মানবসত্তার একেকটি অংশ, তখনই সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

মার্ক্স এই ‘আদর্শিক’ ব্যাখ্যাটিকে এমন একটি ‘বস্তুগত’ আদর্শে রূপান্তরিত করেছেন, যে আদর্শে আমাদের জাগতিক বস্তুগত অভাব মেটানোর সন্তুষ্টিই ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যে আদর্শে একমাত্র শ্রেণিসংগ্রামকেই মুক্তি অর্জনের পথ মনে করা হয়। শ্রমিক শ্রেণিই হবে বিশ্বজনীন মুক্তির হাতিয়ার; কারণ এই আদর্শ ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণাকে অস্বীকার করে এবং যৌথ মালিকানাভিত্তিক উৎপাদনের পথ দেখিয়ে দেয়।

মার্ক্স মনে করতেন, যখন কর্মীরা যৌথ মালিকানাভিত্তিক উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করবে, তখন মার্ক্সের ভাষায় ‘সহযোগিতামূলক সম্পদের ঝরনাধারা’ ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ যে গতিতে ছড়ায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পর্যাপ্ত আকারে সমাজে প্রবাহিত হবে। সম্পদের এই প্রবাহ এতটাই প্রয়োজনাতিরিক্ত হতে পারে, যা বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ কারণে মার্ক্স আয় ও সম্পদ কীভাবে বণ্টন করা হবে, তা নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন দেখেননি। মার্ক্স যখন দুটি জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলের একীভূত হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন, তখন তাঁকে ‘সুষম বণ্টন’ এবং ‘সমানাধিকার’-এর মতো শব্দগুচ্ছকে ‘সেকেলে মৌখিক বাজে কথা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করেছে, বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিলুপ্ত করলেই মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব পরিবর্তন হয় না। বেশির ভাগ মানুষই স্বভাবজাত কারণে সর্বজনীন কল্যাণের দিকে নিজেকে সঁপে দেওয়ার বদলে নিজের হাতে ক্ষমতা ও অগ্রাধিকার চায়, অন্যদের চেয়ে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে চায়। মজার বিষয় হলো এখনো যে দেশগুলো নিজেদের মার্ক্সবাদের অনুসারী বলে দাবি করে, সে দেশগুলোর ইতিহাস বলছে, সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদের প্রবাহ যৌথ মালিকানাভিত্তিক সম্পদ প্রবাহের চেয়ে অনেক জোরালো ছিল।

মাও সে-তুংয়ের আমলে চীনের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র ছিল। মাওয়ের পর ১৯৭৮ সালে তাঁর উত্তরসূরি দেং জিয়াওপিং (যিনি বলেছিলেন ‘বিড়াল সাদা কি কালো সেটা বড় কথা নয়, সেটি ইঁদুর ধরছে কি না, সেটাই বড় কথা’) ক্ষমতায় বসায় চীনের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। এর কারণ হলো দেং জিয়াওপিং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদন অনুমোদন করেছিলেন। তাঁর এই সংস্কারের কারণেই চীনের ৮০ কোটি দরিদ্র মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে এই সংস্কার চীনে ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। যদিও চীন এখনো বলে যাচ্ছে তারা ‘চীনের নিজস্ব আদলের সমাজতন্ত্র’ গড়ে তুলছে। যদিও সেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মার্ক্সের সমাজতন্ত্রের মিল প্রায় নেই বললেই চলে।

চীন যদি মার্ক্সের চিন্তাভাবনার দ্বারা এখন আর প্রভাবিত না হয়, তাহলে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি যে চীনের অর্থনীতির মতো রাজনীতিতেও তিনি এখন আর প্রাসঙ্গিক নন। তারপরও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব রয়েই গেছে। ইতিহাস সম্পর্কে দেওয়া তাঁর বস্তুবাদী তত্ত্ব আমাদের মানবসমাজের চালিকাশক্তির গতি-প্রকৃতি বুঝতে সহায়তা করে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে মার্ক্সের প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায়নি।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
পিটার সিংগার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক