Thank you for trying Sticky AMP!!

কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হতে পারে

ঢাকায় মশার উত্পাত ও মশাবাহিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সবার দৃষ্টি এখন সিটি করপোরেশনের দিকে। তারা কী করছে? প্রতিবছর মশা নিধনের জন্য মোটা বাজেট হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে এই টাকা? মশা দমনে কীটনাশকের অপপ্রয়োগ, কীটনাশক প্রয়োগে অদক্ষতা, কীটনাশক ক্রয়ে অনিয়ম ইত্যাদি অভিযোগ উঠছে। অথচ মশা নিধনের একক দায়দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

মশা দমনে তাদের নিজস্ব অপারেশন টিম আছে। তারা রুটিন করে সকাল–বিকেল বিভিন্ন ওয়ার্ডে স্প্রে ও ফগিং (কীটনাশক) কার্যক্রম চালায়। প্রশ্ন হচ্ছে তাঁরা কি জানেন কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? তাঁদের কাছে এ বিষয়ে পরীক্ষালব্ধ তথ্য আছে, যা দেখে তাঁরা মশা মারার জন্য কার্যকর ডোজ নির্ধারণ করতে পারবেন? নাকি তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ইচ্ছামতো ডোজ নির্ধারণ করছেন, বাড়িয়ে দিচ্ছেন? তাঁরা কি এই কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত?

নানা কথা শোনা যাচ্ছে: ঢাকার মশা নাকি কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে, তাই কীটনাশকে আর মশা মরছে না; কীটনাশকে নাকি ভেজাল আছে। কীটনাশকের ভুল প্রয়োগেই মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। অতিরিক্ত প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্য দেহব্যবস্থার অভিযোজন করতে পি-৪৫০ জিন (প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কীটনাশক দিয়ে এদের আর ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ডোজ যে মশা মারায় অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। 

বর্ষা মৌসুমে শহরে মশার সমস্যা যখন প্রকট হয়, সিটি করপোরেশনকে বেশ তত্পর হতে দেখা যায়। এ সময় কীটনাশক প্রয়োগ হয় বেশি এবং মিডিয়ায় প্রচারণা বাড়ে। কিন্তু তারপরও মশার উত্পাত ও আক্রান্তের সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছেই। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার প্রদুর্ভাব বাড়লে বিভিন্ন চিকিত্সা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদি) সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক ও গবেষকেরা সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসেন। ডেঙ্গু রোগীর সুচিকিত্সায় হাসপাতালগুলোতে (সরকারি–বেসরকারি) চিকিৎসকেরা যথেষ্ট সচেষ্ট থাকেন (তবু প্রতিবছর কিছু রোগী মারা যায়)। বেশি রোগী হলে আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়। তাই বলা যায়, ডেঙ্গুর চিকিত্সা মোটামুটি চললেও এর প্রতিরোধ ঠিকঠাকমতো হচ্ছে না। সুতরাং, মশা নিধনের জন্য (প্রতিরোধের ব্যবস্থা) সিটি করপোরেশনকে নতুন করে ভাবতে হবে।  

দুই সিটি করপোরেশনের চলমান ব্যবস্থায় সফলভাবে মশা নিধন সম্ভব নয়। মশা একটা ছোট পতঙ্গ, এর দমনপদ্ধতি হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত। এ সমস্যা পৃথিবীর অনেক দেশে আছে। কোনো দেশে এই সমস্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রকট। সে জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মশা দমনের নানা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি উদ্ভাবিত হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ নতুন নতুন ফাঁদ আবিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদেরও উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। প্রচলিত দমন পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে হবে। 

সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে ইনটিগ্রেটেড মসকিটো ম্যানেজমেন্ট (আইএমএম) ব্যবস্থায় একটি পৃথক মশা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এর মূল কাজ হবে: ১. মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চালানো, ২. সফল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করা এবং ৩. জনসচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া। এই তিন ধরনের কাজের জন্য মশা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পৃথক শাখা থাকবে। প্রতিটি শাখা এক বা দুজন বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে ও কয়েকজন  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ প্রযুক্তি–ব্যবহারকারীর (টেকনিশিয়ান) দ্বারা পরিচালিত হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের প্রযুক্তি–ব্যবহারকারীদের অবশ্যই মশার জীবতত্ত্ব সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকতে হবে। তাঁরা নিয়মিত মশানাশক ওষুধ (অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভি সাইড) ছিটাবেন। কোন কোন স্থানে কী মাত্রায় মশানাশক ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, সে বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত সংরক্ষণ করবেন। তাঁদের থারমাল ফগার, ইউএলভি স্প্রেয়ার ইত্যাদি নতুন নতুন যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার রপ্ত করতে হবে। তাঁদের এডিস মশাসহ (ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগবাহী) অন্যান্য মশা শনাক্ত করার দক্ষতা থাকতে হবে। তাঁদের টার্গেট ও নন-টার্গেট প্রজাতির পতঙ্গ চিনতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পাশাপাশি মশা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করতে হবে। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সারা বছর নিয়মিতভাবে চালাতে হবে। কোনো মৌসুমেই অবহেলা করা চলবে না। 

মশা দমনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হচ্ছে মশার সার্ভিলেন্স। এই কাজ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি–ব্যবহারকারীরা মিলিতভাবে পরিচালনা করবেন। এই কাজটিও নিয়মিত করতে হবে। এটার ওপর নিয়মিত নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব মশা মানুষ ও প্রাণীদের কামড়ায় (হোস্ট–সিকিং মশা) এবং যেসব মশা ডিম পাড়ার পর্যায়ে আছে (এগ–লেয়িং মশা), সেগুলো দমনের কাজে নানা ধরনের ফাঁদও ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ উদ্ভাবিত হয়েছে (যেমন: লাইট ট্র্যাপ, বিজি ট্র্যাপ, গ্রাভিড ট্র্যাপ, অভি ট্র্যাপ ইত্যাদি)। এভাবে কোন এলাকায় কী কী প্রজাতির মশা আছে, কোথাও জীবাণুবাহী মশা আছে কি না, ইত্যাদি জানা যাবে। জীবাণুবাহী মশা ধরে আরবো–ভাইরাল টেস্ট করতে হবে। নিয়মিত সার্ভিলেন্স করে কোথায় কোন প্রজাতির মশা আছে, তা জেনে নির্দিষ্ট কীটনাশক (ডোজসহ) প্রয়োগে সুপারিশ করতে হবে। তা ছাড়া কোন এলাকায় মশা কী মাত্রায় কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে, তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। নিয়মিত গবেষণা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ টেকসই হবে না।  মশা নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে কীটনাশকের পাশাপাশি জীবতাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই কাজে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উত্পাদন ব্যাহত করে), মেল স্টেরাইল টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে, কিন্তু ডিম উত্পাদন হবে না), বিভিন্ন মশক প্রিডেটরস, যেমন মশক মাছ (গ্যামবুসিয়াসহ অন্যান্য), ওয়াটার বাগ, বিটল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। 

ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক