কী বার্তা দিল চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন?
চাঁদা না দেওয়ায় একজন সাধারণ মুরগি ব্যবসায়ীর পা ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে দিয়েছিল চান্দগাঁওয়ের এসরার বাহিনীর সদস্যরা। সেটা ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। এ ছাড়া কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ এসরারের বিরুদ্ধে। তিন-তিনবার জেলও খেটেছেন তিনি। গতকাল ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এই এসরারুল হক। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তাঁর বিজয় নতুন এক বার্তা দিয়েছে নগরবাসীকে। এই ঘটনা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা এঁকে দেওয়ার জন্যও যথেষ্ট।
নগরের কাউন্সিলর হিসেবে বিজয়ীদের তালিকা দেখলে বোঝা যাবে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন আর বিএনপি নয়; আওয়ামী লীগের ‘সমর্থিত’ আর ‘বিদ্রোহী’প্রার্থীদের মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিএনপিকে মাঠছাড়া করার সাফল্যে উচ্ছ্বসিত আওয়ামী লীগ নেতাদের এবার সামাল দিতে হবে এই ফ্রাংকেনস্টাইনদের। কারণ, এই কয়েক বছরে দলের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাস ও সহিংসতা করে পার পাওয়ার পর এসরারুল হকেরা দেখিয়ে দিয়েছেন দলের সমর্থন ছাড়াও নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যায়। ভবিষ্যতে যেকোনো নির্বাচনে জয়লাভের জন্য পেশিশক্তির কতটা প্রয়োজন পড়বে, তার একটা নমুনাও যেন এবার দেখল সাধারণ মানুষ।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্মরণকালে এত সহিংসতা আর কখনো ঘটেনি। এবার নির্বাচনী প্রচারকালে দুজন ও নির্বাচনের দিন আরও একজনের মৃত্যুসহ শতাধিক ব্যক্তির আহত হওয়ার ঘটনা সাধারণ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। অথচ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে প্রশাসন পুরোপুরি নিরপেক্ষ আচরণ করেছে, এ কথা বলা যাবে না। বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগ তুলেছেন বারবার। সব মিলিয়ে নির্বাচনটা উৎসবমুখর হয়ে ওঠার পরিবর্তে শঙ্কার পূর্বাভাস দিয়েছিল।
অথচ এই সিটি নির্বাচনেই ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে বিএনপি প্রার্থী মীর নাছিরকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আবার ২০১০ সালে আওয়ামী লীগের আমলেই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি–সমর্থিত মনজুর আলম। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যটা তখন উপভোগ করেছিল এই নগরের মানুষ। বলি না যে জনপ্রিয়তা থাকলেও সরকারি দলকে হারতে হবে। কিন্তু পরীক্ষার আগে ফল জানা থাকলে সেই পরীক্ষায় যে মানুষের আগ্রহ থাকে না, তারই যেন কিছুটা প্রমাণ পাওয়া গেল এবার সিটি নির্বাচনে ভোটারদের স্বল্প উপস্থিতি দেখে।
এর আগে পৌরসভা নির্বাচনে ভোটার সমাগম বাড়তে দেখে আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম যে নির্বাচন হয়তো ধীরে ধীরে অর্থবহ হয়ে ওঠার পথে যাচ্ছে। কিন্তু এবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চিত্র ও চরিত্রে আরও একবার মুখ থুবড়ে পড়ল সাধারণ ভোটারদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উন্নত প্রযুক্তির ওপর ভরসা রেখেছিলেন যাঁরা, তাঁদেরও হতাশ হতে হয়েছে এবার। ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে কেন্দ্র দখল বা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমতো সিল মারা যায় না ভেবে অনেকেই সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ও কঠোর তদারকির অভাবে ইভিএম মেশিনটিও যে শক্তিধরের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণই তো হয়ে উঠল এই নির্বাচন। ভোটদান কক্ষের গোপনীয়তা ভেঙে সেখানে যদি পাহারা দিতে থাকে দলীয় ক্যাডাররা, তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেইবা ভোটাধিকারের নামে ভিন্নমত প্রকাশ করতে যাবে?
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ শোনা গেলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কিছুটা আশাবাদ ছিল এর অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে। কিন্তু এবারের নির্বাচন সেই আস্থার জায়গাটা নষ্ট করেছে।
এবার চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের প্রচারণার সময় দুই বড় দলের মেয়র প্রার্থীরই কথাবার্তা ছিল সংযত ও মার্জিত। ব্যক্তিজীবনেও দুজনকেই মার্জিত রুচির মানুষ হিসেবে চেনেন নগরবাসী। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তাঁদের সেই সৌজন্যমূলক আচরণের কোনো প্রভাবই পড়ল না। ক্ষমতাসীন দলের অত্যুৎসাহী ও মারমুখী ক্যাডারেরা নির্বাচনের ন্যূনতম সৌন্দর্যও অক্ষুণ্ন রাখেনি।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ শোনা গেলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কিছুটা আশাবাদ ছিল এর অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে। কিন্তু এবারের নির্বাচন সেই আস্থার জায়গাটা নষ্ট করেছে। ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন দিনের প্রথম ভাগেই। কিন্তু বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন আগেরবারের সংসদ ও সিটি নির্বাচনের মতো অর্ধেকেই রণেভঙ্গ দেননি। শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা জারি রেখেছিলেন তিনি। ফলে বিএনপি আগেভাগেই পরাজয় আঁচ করে মাঠ ছেড়ে দিয়েছে এমন অভিযোগও ধোপে টিকবে না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে প্রত্যাহার না করে তিনি রেজাউল করিমের বিজয়কে যেন পক্ষান্তরে কিছুটা হলেও ম্লান করতে পেরেছেন। কারণ, অনিয়মের চিত্রটা সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা সাধারণ মানুষ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেল।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পেশিশক্তির দাপট ও অন্তর্দলীয় কোন্দল যেমন আওয়ামী লীগকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল, তেমনি অপূর্ণ রাখল নগরবাসীর সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশাকেও।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক।