Thank you for trying Sticky AMP!!

কেন স্বাধীন কাতালোনিয়া চায় না ইইউ?

কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার দাবির গণভোটের পর একই পথ নিল স্পেনের প্রদেশ কাতালোনিয়া। কাতালানদের স্বাধীনতার পক্ষে রায় স্প্যানিশ সরকারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। এমন এক সময় কাতালোনিয়া স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিল, যখন স্পেন গত এক দশকের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। গত দুই বছরে অর্থনীতির সূচকগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। স্পেনের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি হচ্ছে কাতালোনিয়া। কাতালোনিয়া স্পেনের অন্যতম শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল। স্পেনের মোট জিডিপির ১৯ শতাংশ আসে কাতালোনিয়া থেকে। যদি কাতালোনিয়া পৃথক হয়ে যায়, তবে স্পেনের অর্থনীতির ২০ শতাংশের মালিকানা চলে যাবে কাতালানদের হাতে। শেষ পর্যন্ত যদি কাতালোনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়, তবে অর্থনৈতিকভাবে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করবে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) হিসাব অনুসারে কাতালোনিয়ার মোট জিডিপি দাঁড়াবে ২৯২ বিলিয়ন ইউরো, যা পর্তুগাল ও হংকংয়ের থেকে বেশি। জিডিপিতে বিশ্বের ৩৪তম স্থানে থাকবে কাতালানরা। কাতালোনিয়া ৬৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো রপ্তানি থেকে আয় করে, যা স্পেনের যেকোনো প্রদেশের দ্বিগুণ। মাথাপিছু জিডিপি কমবেশি ৩০ হাজার ইউরো, যা দক্ষিণ কোরিয়ার থেকে বেশি।

স্বভাবতই স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্নভাবে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামী নেতা কার্লোস পুজেমনের ওপরও প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে স্পেনের রাজনৈতিক দলগুলো একই সমান্তরালে অবস্থান করছে। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাজয়। স্বাধীনতার কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন স্পেনের বিরোধীদলীয় নেতা পেদ্রো শানচেফও। তবে উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কাতালান পার্লামেন্ট স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সংকট আরও জোরালো হতে পারে। স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে কাতালোনিয়ায় মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। রাজধানী বার্সেলোনায় গত রোববার স্বাধীনতাবিরোধী মিছিলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোক অংশ নিয়েছে। এতে স্পেন ও কাতালোনিয়ার পতাকা নিয়ে মিছিলকারীরা অংশ নেয়। এর আগে গণভোটের দুই দিন পর বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিত স্বাধীনতার পক্ষে মিছিলে লাখো মানুষ অংশ নিয়েছিল। তবে ৪৩ শতাংশ ভোটার গণভোটে অংশ নিয়েছে। তাই স্বাধীনতাবিরোধীদের মতামতও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

এ ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশের নেতাদের অবস্থানকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, কাতালোনিয়ার গণভোট ও স্বাধীন কাতালোনিয়ার বড় প্রভাব থাকবে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। তাই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ইউরোপীয় নেতাদের অবস্থানও অনেকটাই পরিষ্কার। কার্লোস পুজেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মধ্যস্থতার আহ্বান জানালেও ব্রাসেলস এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কাতালোনিয়ার প্রতিবেশী ফ্রান্স জানিয়েছে, কাতালোনিয়ার একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা তারা স্বীকৃতি দেবে না। ইউরোপীয় নেতাদের আশঙ্কা, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে স্বাধীনতার চেতনাকে উসকে দিতে পারে। জার্মানির বাভারিয়া, ইতালির সার্দিনিয়া, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে পৃথক হওয়ার রাজনীতি জোরদার হতে পারে। ফ্রান্সের নরম্যান্ডি, ব্রিটেনের অর্কনি দ্বীপ, ডেনমার্কের বর্নহম অঞ্চলে অধিকতর ক্ষমতা অর্জনের কর্মসূচি জোরালো হচ্ছে। ব্রিটেনের ইইউ থেকে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এসব অঞ্চলের পৃথক হওয়া বা অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে নিশ্চিত করেই।

কাতালানরা কেন স্বাধীনতার পক্ষে পথে নেমেছে বা অন্যান্য অঞ্চলের জনসাধারণ কেন পৃথক হতে চাইছে বা অধিক ক্ষমতা লাভের চিন্তাভাবনা করছে? কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে অঞ্চলভেদে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা অনগ্রসর অঞ্চলের সঙ্গে আর সম্পদের ভাগাভাগিতে যেতে চাইছেন না। যেমন কাতালানদের একটি অংশ মনে করছে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় স্পেনের অর্থনীতির ভার তাদের অনেকটাই বহন করতে হয়েছে। স্পেনের অর্থনীতিতে তাদের যে অবদান, সে হিসাবে প্রাপ্তি কম। ওইসিডির হিসাব অনুসারে স্পেনে বেকারত্বের হার এই মুহূর্তে ১৮ শতাংশ। আর কাতালোনিয়ায় ১৩ শতাংশ। স্পেন ইইউয়ের অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্র নীতির শিকার হয়েছে। স্পেন সরকার অবকাঠামো খাত থেকে বাজেট প্রত্যাহার করে কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেই হারে বেকারত্ব হ্রাস পায়নি। উল্টো সরকার সামাজিক নিরাপত্তার খাতের ব্যয় সংকোচন করেছে। স্পেনের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদাতা কাতালানরা এই উদ্যোগগুলো ভালোভাবে নেয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত তাদের মনঃপূত হচ্ছে না। তাই বলা যায়, দীর্ঘদিনের স্প্যানিশ শাসন ও শোষণের কারণে কাতালানদের স্বাধীনতার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় এবার অর্থনৈতিক ভাবনাও যুক্ত হয়েছে।

অর্থনৈতিক মন্দা অনেক সময়ই রাজনীতির মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। হতে পারে সেটা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বা কখনো যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে। গত শতকের ত্রিশের মহামন্দা বিশ্বরাজনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল। বিশ্বক্ষমতার ভরকেন্দ্রই স্থানান্তরিত হয়ে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় চলে যায়। সাম্প্রতিক মন্দারও অবশ্যম্ভাবী প্রভাবের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। বিশেষ করে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? এর কিছু কিছু প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। এশিয়ায় মূলত চীনকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এক নতুন ক্ষমতা বলয়ের উত্থান ঘটছে। নতুন বলয়ের অনেক কিছুই এখন প্রচলিত ইউরো-মার্কিনকেন্দ্রিক ‘গ্লোবাল গভর্নেন্স’-কে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যেমন বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস ব্যাংকের উত্থান।

ইউরোপে মন্দার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। মন্দার ফলে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি ও ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে ইউরোপের রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশই এখন আর অর্থনীতির বোঝা ভাগাভাগি করতে রাজি হচ্ছে না। শুধু দেশই না, এটি ক্রমে আঞ্চলিক চেতনায় রূপ নিচ্ছে। দেশের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে অনেক অঞ্চলই বরং নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একধরনের অর্থনৈতিকবোধ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাতে তাড়িত করছে। এই জায়গা থেকে স্কটিশরা স্বাধীনতার ভোটে গিয়ে হেরে গিয়েছে। তবে স্পেনের কাতালানরা স্বাধীনতার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। স্কটিশ ও কাতালানরা সফলকাম হোক না হোক, কিন্তু তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও স্বাধীনতার চেতনাকে উসকে দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপের অন্যান্য অনেক অঞ্চলও কি কাতালোনিয়ার মতো বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বেরিয়ে যাবে? ইউরোপ কি আবারও ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র আঞ্চলিক বা নগর রাষ্ট্রের যুগে ফিরে যাবে? রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শক্তির ভারসাম্য কীভাবে বজায় থাকবে? তাই কাতালোনিয়ার গণভোটের রায় একটি বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে, ইউরোপ কি গণতন্ত্রহীনতায় ভুগছে বা স্থানীয় পর্যায়ে কি আরও গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বিতরণ করতে হবে? রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বা ইইউ থেকে যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি বা প্যাকেজ স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো জনসাধারণ গ্রহণ করছে না। এ কারণেই বিভিন্ন অঞ্চলের পৃথক হওয়া, স্বাধীন হওয়া বা আরও স্বায়ত্তশাসনের চেতনা ক্রমে বিকশিত হচ্ছে। এমনকি ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভাবনাও জোরালো হচ্ছে। সব থেকে বড় প্রশ্ন, ১৯৬০-এর দশকে যে ভাবনার জায়গা থেকে ইইউ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেই জায়গায় কি ইইউ পৌঁছাতে পারেনি? বলা হয়ে থাকে, ইইউয়ের গঠন-কাঠামোতে যথাযথ গণতন্ত্র নেই বা গণতান্ত্রিক সংকটে ভুগছে বা ইইউয়ের সিদ্ধান্তে যথাযথভাবে জনমত প্রতিফলিত হচ্ছে না। মন্দা মোকাবিলায় ইইউয়ের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করায় রাষ্ট্রগুলোর আঞ্চলিক পর্যায়ে তাই ক্ষোভ, বিক্ষোভ বাড়ছে। ইইউকে টিকিয়ে রাখতে হলে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই ইউরোপের নেতাদের অগ্রসর হতে হবে।

ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি