কে বলে ফারুক চৌধুরী নেই?
সবাই বলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই বলবেন তিনি না থেকেও আছেন। আমাদের চিন্তায় সব সময় তাঁর উপস্থিতি টের পাই। সেই যে কবি জীবনানন্দ দাশ লিখে গেছেন, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। আজ ফারুক ভাই নেই, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর খুব উঁচু মাপের মানবসত্তা।
আমরা সব সময় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতাম। তাঁর বাসায় গেলে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললেও মনে হতো আরও কথা শোনা বাকি রইল। আরও কিছুক্ষণ থাকি তাঁর কাছে। আরও কিছু নতুন কথা শুনি। জানি।
কোনো কিছু জানতে হলে তাঁকে ফোন করতাম। এমন কোনো বিষয় নেই, যা তিনি জানতেন না বা বুঝিয়ে বলতে পারতেন না। মনে হতো তিনি জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া! এখন এই এনসাইক্লোপিডিয়ার ছাপা বই অনলাইনে আছে। ফারুক ভাইয়ের লেখা, চিন্তাভাবনা, আকাশচুম্বী জ্ঞান—সবই এখন কিছু ছাপা বই আর কিছু ভার্চ্যুয়াল সংস্করণে আছে। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যে দু-চারজন তাঁর খুব কাছে যেতে পেরেছি, তাঁদের স্মৃতিতে তিনি সব সময় জেগে আছেন।
এনসাইক্লোপিডিয়ার কথাটা তাঁর মুখেই শোনা। ছোটবেলা থেকেই আমি কোনো কিছু জানার জন্য ২৪ খণ্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া খুলে বসতাম। ষাটের দশকে কিছু জানার সেটাই ছিল খুব ভালো মাধ্যম। একদিন কথায় কথায় জানলেন যে আমি প্রয়াত অর্থসচিব গোলাম কিবরিয়ার ছোট ভাই। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ও, কিবরিয়া তো জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া! সে তো সব সময় এনসাইক্লোপিডিয়ায় ডুবে থাকে।’ প্রয়াত সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক ভাই ছিলেন তাঁর খুব ভালো বন্ধু।
কোনো জ্ঞানী মানুষ যে এনসাইক্লোপিডিয়ার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন, সেই ধারণাটা পাওয়ার পর আমি সব সময় মনে মনে ফারুক ভাইকেও জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে বিবেচনা করে এসেছি। যথেচ্ছভাবে তাঁর জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করেছি। তিনি সব সময় স্নেহশীল হয়ে আমাদের মতো অনেককে সেই অধিকার দিয়েছেন। এই গুণটিই তাঁকে চির মাহাত্ম্যে মহিমান্বিত করেছে।
আমি বিজ্ঞানের টুকিটাকি বিষয়ে লিখতাম। একদিন কিবরিয়া ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম বড় সাহেবদের চেয়ারের পেছনে তোয়ালে থাকে কেন? তিনি বললেন, স্বাধীনতার পর অফিসকক্ষ ছিল কম। বড় কর্মকর্তাদের হয়তো একই ঘরে দু-তিনটা টেবিলে পাশাপাশি বসতে হতো। কোনো অতিথি এসে বুঝতে পারতেন না কার কী পদমর্যাদা। তখন তোয়ালে লাগানো হলো। উঁচু পদের সাহেবের জন্য দামি তোয়ালে, তারপর পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন মানের তোয়ালে।
এরপর আরও জানার জন্য ফারুক ভাইকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, কথাটা ঠিক, তবে এই তোয়ালে সংস্কৃতির সূত্রপাত ব্রিটিশ আমলে। সে সময় কলকাতার উঁচু পদের বাবুরা মাথায় চুবচুবা তেল মেখে অফিসে এসে চেয়ারে বসে পেছনে মাথা এলিয়ে দিতেন। ব্রিটিশ সাহেবরা দেখলেন, এ তো মহাবিপদ। চেয়ার নষ্ট হচ্ছে। তাঁরা বললেন, লাগাও তোয়ালে। নষ্ট হলে হবে তোয়ালে, চেয়ার তো বাঁচবে!
আমি দেখলাম আরে, ফারুক ভাইয়েরা তো জ্ঞানের খনি। তাঁদের কথা লিখলাম।
ফারুক ভাই চিরনিদ্রায় শায়িত। কিন্তু এখনো তিনি আমাদের কাছে জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া।
একবার ফারুক ভাই বললেন, ‘মুকুল, তোমাদের অফিসে আমার জন্য একটা আলাদা কক্ষ চাই। তোমরা যেমন অফিস করো, আমিও মাঝেমধ্যে এসে অফিস করব। লিখব। তোমরা তো সব সময় আমার লেখা ছাপাও।’
মতি ভাই তো মহাখুশি। তখনই তাঁর জন্য একটা কক্ষ বরাদ্দ হলো। তিনি ঘরের চাবি নিয়ে রাখলেন তাঁর কাছে। বেশ কিছুদিন তিনি ইচ্ছেমতো অফিস করেছেন। লিখেছেন। তিনি এসেই বলতেন, ‘মুকুল, গরম শিঙাড়া আর চা। এই আমার চাওয়া।’ ক্যানটিনে অর্ডার দেওয়ামাত্র এসে যেত। কারণ, অফিস সহকারীরা জানতেন, ফারুক ভাই মানেই গরম শিঙাড়া আর চা। তারপর তাঁর লেখা আর আমাদের গল্প চলত।
ফারুক ভাইয়ের বাসায় যখনই গেছি, খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো প্লেটে শিঙাড়া আর অন্যান্য উপাদেয় খাবার এসে যেত। সঙ্গে চা। মাঝেমধ্যে দাওয়াত দিতেন। আসতেন অনেক কূটনীতিক। শিল্পী-সাহিত্যিক। তাঁদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসার অতিথিকক্ষটি বিশাল। বিশেষ কায়দায় সাজানো। কিছু তফাতে অন্তত তিন-চারটি স্থানে ছোট টেবিল ঘিরে রয়েছে তিন-চারটা করে সোফা-চেয়ার। সেখানে অতিথিরা যাঁর যাঁর পছন্দমতো তিন-চারভাগে আসর বসাতে পারতেন। কেউ আবার এক আসর ছেড়ে অন্য আসরে যোগ দিতেন। ফারুক ভাই ও ভাবি ঘুরে ঘুরে আসতেন বিভিন্ন আসরে। কখনো তাঁর দাওয়াতে গিয়ে একঘেয়েমি লাগেনি।
একবার তিনি ব্র্যাক সেন্টার ভবনে কাজ করছিলেন। বুকে ব্যথা হচ্ছে টের পেয়ে নিজেই চলে গেলেন গুলশান-১ গোলচত্বরের কাছে একটি কার্ডিয়াক হাসপাতালে। আমি এ খবর শুনে ওই হাসপাতালে যাই। সেটা অনেক আগের কথা। হয়তো ২০-২২ বছর আগে। তখনো আমাকে তিনি তত ভালো চেনেন না। শুধু প্রথম আলোয় লিখতেন, এটুকুই পরিচয়ের সূত্র। ছোট হাসপাতাল। আমি তাঁর ঘরে ঢুকে পড়লাম। এক কোণে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর প্রতি সহমর্মিতা জানাতেই গেছি। ঘরে তখন সব আত্মীয়স্বজন। কিছুক্ষণ থেকে চলে আসি।
পরে তিনি বললেন, ‘বুঝেছ, কাজ করছি, হঠাৎ বুকে চিনচিন ব্যথা। আমি তো বুঝে গেছি, হার্টের কোনো গন্ডগোল। সোজা হাসপাতালে চলে যাই। ডাক্তাররা বললেন, আপনি ঠিক সময়ে এসে গেছেন। দেরি করলে ক্ষতি হতো।’ তারপর বললেন, ‘বুঝলে, একটু সচেতন থাকলে অনেক বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।’
কয়েক দিন আগে ফারুক ভাই ফোন করে বললেন, ‘লেখা তৈরি। কাউকে পাঠিয়ে আজই নিয়ে যাও। সম্ভব হলে কালই পত্রিকায় ছাপিয়ে দাও। একেবারে টাটকা বিষয়ে লেখা।’
ফারুক ভাইয়ের ফোন পেলে আমি অস্থির হয়ে যেতাম। তিনি এত অসুস্থ অবস্থায়ও লিখে গেছেন। নিজের হাতে লিখতেন।
আজ আর ফারুক ভাইয়ের কোনো ফোন পাব না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
আরও পড়ুন
-
‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর’
-
যুক্তরাষ্ট্রে শিখ নেতা পান্নুন হত্যাচেষ্টায় ভারতের ‘র’ জড়িত
-
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক বেশি অভিযুক্ত’
-
চট্টগ্রামে ২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় দেখা যাবে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ
-
ফিলিপাইনে গরমে জেগে উঠেছে ডুবে যাওয়া শহর