Thank you for trying Sticky AMP!!

কোথায় থামবেন বিন সালমান

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স

২০১৫ সালের ২১ মার্চ। তুরস্কের দিয়ারবাকের শহরে কুর্দিদের বার্ষিক নওরোজ উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। উৎসবকে কাছ থেকে দেখার পাশাপাশি আমার কুর্দি প্রফেসরের কল্যাণে এক ইরাকি কুর্দি বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ১৯৮৭ সালে সাদ্দাম হোসেনের রাসায়নিক গ্যাস হামলায় পুরো পরিবার হারিয়েছিলেন। নিজেও চরমভাবে আহত হয়েছিলেন। দীর্ঘ সাক্ষাতের এক সময়ে বৃদ্ধ সেরহাত দিঞ্চ বলেছিলেন, ‘আমরা সাদ্দামের অত্যাচারে এতই অতিষ্ঠ ছিলাম যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতাম, কখন এই অত্যাচার থামবে!’ মার্কিনদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে সাদ্দাম হোসেনের পতন হয়েছে, কিন্তু অত্যাচার থামেনি। মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম হয়েছে নতুন এক সাদ্দাম হোসেনের। নাম মোহাম্মাদ বিন সালমান।

নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে প্রকাশ, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা সাদ আলজাবরি তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য যুবরাজ মোহাম্মদসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মার্কিন ফেডারেল আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে সাদ আলজাবরি উল্লেখ্য করেন, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির কায়দায় তাঁকেও হত্যার উদ্দেশে যুবরাজ কানাডায় একটি ‘হিট স্কোয়াড’ পাঠিয়েছিলেন। সাদ আলজাবরির দোষ, তিনি যুবরাজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের খুবই ঘনিষ্ঠ, যিনি কিনা সৌদি সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার এবং জামাল খাসোগির মতোই আল জাবরিও রাজপরিবারের অন্দরমহলের খবর জানেন।

যুবরাজের অপকর্মের আমলনামা বেশ দীর্ঘ। আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনের ওপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া, ২০১৭ সালে রিয়াদের একটি হোটেলে রাজপরিবারসহ বেশ কিছু সম্পদশালী ব্যবসায়ীকে বন্দী করে রাখা, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে শারীরিক অত্যাচার করে পদত্যাগে বাধ্য করা, কাতার অবরোধে নেতৃত্ব দেওয়া, আমাজন সিইও জেফ বেজোসের ব্যক্তিগত ফোন হ্যাকিং করা, যুবরাজের নতুন প্রকল্পের জন্য নিজ গোত্রীয় ভূমি ছাড়তে অস্বীকার করার দরুন আল হাওয়াটি নামে এক গোত্রনেতাকে হত্যা করাসহ নানান অপরাধে অভিযুক্ত যুবরাজ। তবে ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যার ঘটনা তাবৎ দুনিয়ার টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল। জামাল খাসোগি সৌদি রাজপরিবারে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। পশ্চিমে সৌদি রাজপরিবারের সব চুক্তির অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন জামাল খাসোগি। সময়ের পরিবর্তনে বদলে যাওয়া জামাল খাসোগি যাতে রাজপরিবারের জন্য হুমকি না হতে পারেন, সে জন্যই খুন হন।

তাবৎ বিশ্বমোড়লের সামনেই যুবরাজ এভাবে খুনখারাবি করে যাচ্ছেন, তবু সবাই একদম নিশ্চুপ। সৌদি প্রসঙ্গ উঠতেই পশ্চিমা গণতন্ত্র, মানবাধিকারের রথ থেমে যায়। অন্য দেশগুলোয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বুলি মুখে নিয়ে পশ্চিমারা যখন অহরহ বন্দুক ও ট্যাংক নিয়ে হাজির হয়, সেখানে যুবরাজের ক্রমাগত অপকর্মের পরেও পশ্চিমে কেন লালগালিচা সংবর্ধনা পাচ্ছেন, তা হয়তো সচেতন পাঠকের আগ্রহের প্রশ্ন হতে পারে।

২০১৫ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর যুবরাজের বাবা সালমান বিন আবদুল আজিজ সিংহাসনে আরোহণ করলে আচমকা ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে সৌদি যুবরাজের। সালমান নিযুক্ত হন প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে। পশ্চিমাদের সঙ্গে আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা যুবরাজ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ইয়েমেনে সামগ্রিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে ইয়েমেনের পাশাপাশি ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়ার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশীদারত্ব না থাকলেও অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সৌদিরা এসব গৃহযুদ্ধের প্রধান পক্ষ।

পুঁজিবাদী পশ্চিমা সভ্যতা কখনোই ক্রেতা চিনতে ভুল করে না। সাদ্দাম, বাশার আল–আসাদ এবং গাদ্দাফির পর পশ্চিমারা যুবরাজের মতো ক্রেতার সন্ধান পেয়ে যুবরাজের সমর্থনে গীত গাইতে শুরু করল। প্রতিদানস্বরূপ পশ্চিম থেকে যুবরাজ পানির মতো অস্ত্র ক্রয় শুরু করেন। সম্প্রতি যার পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছে স্টকহোম আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০-১৪ সময়ের তুলনায় ২০১৫-১৯ সালে সৌদির অস্ত্র ক্রয় ১৩০ শতাংশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশ্বের মোট অস্ত্র ক্রয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাধিক। সৌদি অস্ত্রের প্রধান জোগানদাতা মার্কিন এবং ব্রিটিশরা। মোট আমদানির ৭৫ শতাংশ মার্কিনরা, ১৫ শতাংশ ব্রিটিশরা এবং বাকিটুকু সরবরাহ করে রাশিয়া, চীনসহ অন্যরা। টাকার অঙ্কের হিসাবে গত পাঁচ বছরে যুবরাজ মার্কিনদের থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার, ব্রিটিশদের কাছে থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্স, স্পেন এবং জার্মানি থেকে যথাক্রমে ৮০০ মিলিয়ন, ৪০০ মিলিয়ন, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছেন।

সৌদি যুবরাজ আর পশ্চিমাদের এই দহরম-মহরমের অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে যুবরাজের পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে বহুলাংশে মার্কিনদের সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছে। যুবরাজ ঐতিহাসিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা আরব বিশ্বসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর আগামীর রাজনৈতিক কাঠামো বদলে দিতে পারে।

প্রথমত, মার্কিনদের বিশেষভাবে ট্রাম্পের শতাব্দীর চুক্তি বাস্তবায়ন। ক্ষমতার শুরু থেকেই যুবরাজ ইসরায়েলের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন ব্যক্ত করে এসেছেন। কয়েক বছর আগে মার্কিন মুলুকের এক টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমান ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার আছে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে মাহমুদ আব্বাসকে চেঁচামেচি না করে ট্রাম্পের শতাব্দীর চুক্তি মেনে নিতে বলেছেন। যুবরাজের এই উক্তি ইসরায়েলের বৈধতাকে নিশ্চিত করার পাশাপাশি গত এক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনে চলে আসা ইসরায়েলি উপনিবেশবাদকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুবরাজের এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশকে বাধ্য করবে ইসরায়েলি উপনিবেশবাদকে স্বীকৃতি দিতে।

দ্বিতীয়ত, ইরানকে মোকাবিলা। মোটাদাগে সুন্নি–অধ্যুষিত অধিকাংশ দেশ পশ্চিমা নব্য–উপনিবেশবাদ মেনে নিলেও ইরান কঠোরভাবে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রতিরোধ লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের যুদ্ধের ময়দানে জাজ্বল্যমান। আফগানিস্তান ও ইরাকে সম্মুখযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর মার্কিনরা সম্মুখযুদ্ধে আগ্রহ হারিয়েছে। তাই ইরানকে মোকাবিলায় স্থানীয় কোনো সৈন্যবাহিনীকে প্রয়োজন। দরকার পড়লে সৌদি বলয়ের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলো তা মেটাতে পারবে। সঙ্গে কুর্দিরা তো আছেই। যারা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সমীকরণের নাড়ি-নক্ষত্র জানেন, তাঁরা লিবিয়া এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মধ্যেই আগত ইরান যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখেছেন।

তৃতীয়ত, অটোমান–পরবর্তী সময় থেকেই, ১০০ বছর ধরে আরব বিশ্ব পশ্চিমা উপনিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই উপনিবেশবাদ নিজেরদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং জীবনবোধকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। একই সঙ্গে এই উপনিবেশবাদ ব্যতিক্রমধর্মী এক হাইব্রিড আরব জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে, যে জাতীয়তাবাদ তাদের সব দুর্দশার জন্য অটোমান ও ‘রাজনৈতিক ইসলামকে’ দোষারোপ করে এবং পশ্চিমেই সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়। সম্প্রতি এই হাইব্রিড আরব জাতীয়তাবাদের নিদর্শন হলো বৈরুতে ‘বিস্ফোরণ’–পরবর্তী সময়ে পুনরায় ফরাসি উপনিবেশবাদে ফিরে যাওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষের আগ্রহ প্রকাশ করা। মোটাদাগে মোহাম্মাদ বিন সালমান এই হাইব্রিড জাতীয়তাবাদের অন্যতম খুঁটি, যার প্রধান সঙ্গী আরব আমিরাত, লিবিয়ার হাফতার এবং মিসরের সিসি।

লাগামহীন অপকর্মের পরে পশ্চিমা গণমাধ্যমে যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান একজন সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপিত। পশ্চিমা মিডিয়ায় যুবরাজের এই ইতিবাচক খবরগুলো আমাদের অতীত স্মরণ করিয়ে দেয়। ইরান বিপ্লবের পর যখন সাদ্দাম হোসেন বিনা উসকানিতে ইরান আক্রমণ করেছিলেন, তখন নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছিল ‘মৌলবাদের বিরুদ্ধে সাদ্দামের অভিযান’। একইভাবে যখন আফগানরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল, তখন নিউইয়র্ক টাইমস লাদেনকে ‘ত্রাতা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান পশ্চিমের ওই পুঁজিবাদী উপনিবেশকারীদের আরেক স্থানীয় প্রতিনিধি। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মুক্তিকামীদের কাজ আরও কঠিন হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে নতুন এই স্থানীয় প্রতিনিধির আগমন এক জটিল সমীকরণের জন্ম দিয়েছে।

রাহুল আনজুম: গবেষক