Thank you for trying Sticky AMP!!

ক্রসফায়ারে নিহত সত্যের দুনিয়ায়

ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পর তাঁর দেহ ইসলামি রীতি অনুসারে দাফন করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এটাই আমাদের বলেছিল। লাদেন ছিলেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের এক দেয়ালঘেরা বাড়িতে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী কমান্ডো অভিযান চালানোর সময় প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তখন গুলিতে লাদেন নিহত হন—এই রকমই আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল।

২০২০ সালের জুলাইয়ে প্রথম আলো একটি ঈদসংখ্যা বের করেছে। ঈদ আনন্দ সংখ্যা ২০২০। এই ঈদসংখ্যায় রওশন জামিলের একটা লেখা বেরিয়েছে, ‘অপারেশন ওসামা বিন লাদেন’। সেই লেখাটা তিনটি লেখা অবলম্বনে গবেষণা করে মুসাবিদা করেছেন রওশন জামিল। ও মাই গড! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তঁার সরকারি মুখপাত্ররা সারা দুনিয়ার মানুষের সামনে আগাগোড়া মিথ্যা বলেছেন! জেনেশুনে বলে গেছেন জলজ্যান্ত মিথ্যা। একটা মিথ্যা ঢাকতে তঁাদের বানাতে হয়েছে আরও আরও মিথ্যা!

২ মে ২০১১, পাকিস্তান সময় রাত দেড়টায় পরিচালিত সেই লাদেন অপারেশনে আসলে আমেরিকানদের কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীনই হতে হয়নি। কমান্ডোরা আগে থেকেই জানতেন, তঁারা একটা খুন করতে যাচ্ছেন। লাদেন তিন স্ত্রী ও শিশুদের নিয়ে নিজের ঘরে কোনো প্রতিরোধ ও পাহারা ছাড়াই অবস্থান করছিলেন। সেখানে বেডরুমে তাঁকে গুলি করে শতচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তারপর তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানে আমেরিকান ঘাঁটিতে। কথা ছিল, সাত দিন পরে বলা হবে, আফগানিস্তানের পাহাড়ি এলাকায় বোমা মেরে লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে (এক মিথ্যা)। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তড়িঘড়ি ঘোষণা করেন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে।

এতে অভিযান পরিচালনাকারীরা বিপদে পড়ে। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বোধ করে। পাকিস্তানিদের মধ্য থেকে যারা বাড়িটার খবর দিয়েছিল, তারা বিপন্ন হয়ে যায়। তখন একের পর এক মিথ্যা কথা বলা হয়। লাশ দাফনের ভুয়া ছবি বানানো হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ কথা, আসল তথ্যদাতা একজন পাকিস্তানিকে বাঁচানোর জন্য আরেকজন পাকিস্তানিকে আমেরিকানরা ফাঁসিয়ে দেয়। লাদেনের ডিএনএ আমেরিকানদের দিয়েছিল আজিজ। তাকে বাঁচাতে শাকিল আফ্রিদি নামের একজন ডাক্তারকে বলির পাঁঠা বানানো হয়। খবর ছড়ানো হয়, আফ্রিদির টিকাদান কর্মসূচি আসলে ভুয়া। লাদেনের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য করা। আফ্রিদিকে পাকিস্তানিরা আটক করে। পাকিস্তানে বহু টিকাদানের কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়। এসবই ছিল আমেরিকার মিথ্যাচারের কুফল।

আমেরিকার সাংবাদিকেরা তথ্য অধিকার আইনের আওতায় প্রকৃত সত্য জানার জন্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেন। সেসব প্রশ্ন অতি গোপনীয় বলে ধামাচাপা রাখা হয়। আমেরিকার মতো দেশ আর ওবামার মতো প্রেসিডেন্ট যদি এই রকম মিথ্যাচার করেন, তাহলে অন্য রাষ্ট্রগুলো মিথ্যাচারের কী রকম মহড়া প্রকাশ্যে, গোপনে, আনুষ্ঠানিকভাবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে করছে, তা ভাবলে শরীর হিম হয়ে আসে। বলা হয়ে থাকে, যখন যুদ্ধ বাধে, তখন প্রথম মারা যায় সত্য। আর আমরা দেখতে পাচ্ছি, যুদ্ধ সব সময়ই চলছে, সব সময়ই সবার আগে ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যাচ্ছে সত্য।

লাদেনকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেন আমেরিকান কমান্ডোরা। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আর সেই হত্যাকাণ্ডের দাগ হাত থেকে মুছে ফেলতে সাজানো হয় ক্রসফায়ারের গল্প।

২. বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে এ পর্যন্ত ক্রসফায়ার, শুটআউট, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ২ হাজার ৮৫০ জন। আর ১৩ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড–১৯–এ মারা গেছেন সরকারি হিসাবে ৩ হাজার ৫১৩ জন। করোনাভাইরাসের চেয়ে ক্রসফায়ার কম প্রাণঘাতী নয়!

ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, শুটআউট, বন্দুকযুদ্ধ—বিনা বিচারে হত্যার মতো বিষয়টা কখনো কখনো সমাজের কোনো কোনো অংশের সমর্থন পেলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো, নাগরিক সমাজ, সংবাদমাধ্যম, লেখক-সাহিত্যিকেরা মোটের ওপর তা সমর্থন করেননি। তাঁরা সেই ২০০৪ থেকেই এর বিরুদ্ধে লিখে আসছেন। প্রথম আলোয় ক্রসফায়ার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজেই অন্তত ১০ বার লিখেছি। মে ৩, ২০১১ সালে আমার লেখার শিরোনাম ছিল, ‘যা দিতে পারো না, কেড়ে নিয়ো না।’ তাতে লিখেছিলাম, ‘গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার দেখা করতে গেলেন দার্শনিক ডায়োজেনিসের সঙ্গে। দার্শনিক তখন একটা চৌবাচ্চায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। আলেক্সান্ডার তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?” ডায়োজেনিস উত্তর দিলেন, “সূর্য আর আমার মধ্য থেকে সরে দাঁড়ান। আপনি আমার রোদ আটকে রেখেছেন। আপনি যা আমাকে দিতে পারেন না, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারেন না।’”

মানুষের প্রাণও কেউ দিতে পারে না। কাজেই সেটা কারও কাছ থেকে কেড়ে নেওয়াটাও উচিত নয়, একেবারেই অনন্যোপায় না হয়ে থাকলে।’

আমি তো মৃত্যুদণ্ডেরই বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে দেখা গেছে, বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে যাদের, তাদের অনেকেই আসলে নির্দোষ ছিল। ভুল লোককে সাজা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ২০১১ সালে যা লিখেছিলাম, আজও তা প্রাসঙ্গিক বলে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

‘শুধু ভুলক্রমে নিরীহ, নিরপরাধ লোক মারা পড়লে আমরা প্রতিবাদ করি, সোচ্চার হই। কিন্তু ভুল হতে পারে বলেই একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। তাৎক্ষণিকভাবে ক্রসফায়ার একটা সমাধান দেয় বটে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতিও হয়, কিন্তু এটা চলতে দেওয়া যায় না। আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া যায় না কাউকে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নয়। তাদের হাতে অস্ত্র থাকে বলেই তাদের আইন মেনে চলতে হবে কঠোরভাবে। আর এ ধরনের ভুল যে কেবল অনিচ্ছাকৃতভাবে হতে পারে, তা-ই নয়, এই দুর্নীতিকবলিত দেশে, এই রাজনৈতিক হানাহানির দেশে প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে, জমিজমার গোলযোগ থেকে, পারিবারিক প্রতিহিংসা থেকে, এমনই হাজারটা উপলক্ষে দুর্নীতিতাড়িত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেকোনো সদস্যের, একটা বাহিনীর সুনাম যা নষ্ট করে দিতে পারে একেবারেই।’

আমি ক্রসফায়ার নিয়ে, গুম নিয়ে একাধিক গল্প লিখেছি, উপন্যাস লিখেছি, সেখান থেকে টেলিভিশন নাটক হয়েছে। আমাদের বহু লেখক, বহু সাংবাদিক দিনের পর দিন লিখে গেছেন। কিন্তু যাঁরা এসব করেন, তাঁরা এই সব নাগরিকের লেখা বা কথা সামান্যই গ্রাহ্য করেন।

৩. ২০০৬ সালে হুমায়ূন আহমেদ বইমেলায় প্রকাশ করেছিলেন হলুদ হিমু কালো র‍্যাব। হিমুকে র‍্যাব ধরে নিয়ে গেছে। হাজতে তার পাশে একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। তার নাম মুরগি ছাদেক। এক দিন পর কাগজে ছাপা হলো, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি ছাদেক ক্রসফায়ারে নিহত।’ র‍্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। তাকে নিয়ে অস্ত্রভান্ডারের খোঁজে গাজীপুরের দিকে যেতে থাকে। পথে সন্ত্রাসীরা হামলা করে। র‍্যাবও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই সময় ক্রসফায়ারে পড়ে মুরগি ছাদেক নিহত হয়। এই বইয়ে হিমুর সঙ্গে র‍্যাব কর্মকর্তার কথোপকথন:

‘আপনি কেন আমাদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না, বলুন তো? আপনার যুক্তিটা শুনি। আপনি কি চান না ভয়ংকর অপরাধীরা শেষ হয়ে যাক? ক্যানসার সেলকে ধ্বংস করতেই হয়। ধ্বংস না করলে সেল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।’

হিমু জবাব দিয়েছিল, ‘স্যার, মানুষ ক্যানসার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যত্নে তৈরি করে। একটা ভ্রূণ মায়ের পেটে বড় হয়। তার জন্য প্রকৃতি কী বিপুল আয়োজনই না করে! তাকে রক্ত পাঠায়, অক্সিজেন পাঠায়। অতি যত্নে শরীরের একেকটা জিনিস তৈরি হয়। দুই মাস বয়সে হাড়, তিন মাসে চামড়া, পাঁচ মাস বয়সে ফুসফুস। এত যত্নে তৈরি করা একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মরে যাবে—এটা কি ঠিক?’

৪. আলবেয়র কামু তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণে (১৯৫৭) বলেছিলেন, ‘আমাদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা যা–ই থাকুক না কেন, খুব কষ্টকর হলেও আমাদের দুটো অঙ্গীকার মেনে চলতে হবে: ১. মিথ্যা কথা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ২. নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে।’

‌রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট। (আজ কবি শহীদ কাদরীর জন্মদিন।) লাদেনকে নিয়ে বারাক ওবামাদের মিথ্যাচার আমেরিকানরাই উন্মোচন করেছেন। সেটা পড়ে রাষ্ট্রাচার সম্পর্কে উদ্ধারহীন হতাশায় ভুগছি।

আজ ক্রসফায়ার এবং কল্পিত কাহিনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। আমরা বলব, এই প্রতিবাদটুকুর মধ্যেই আমাদের আশা, এই প্রতিবাদটুকুর মধ্যেই আমাদের পুনর্বার মানুষ হয়ে জেগে ওঠার জিয়নকাঠিটি বিরাজ করছে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক