Thank you for trying Sticky AMP!!

গণতান্ত্রিক শক্তি এককাট্টা নয়

আফ্রাসিয়াব খটক

পাকিস্তানে একদিকে গত দুই দশকে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের দ্রুত বিস্তার, অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমের চিত্তাকর্ষক বিস্তার-এই উভয়বিধ কারণে দেশটিতে মানুষে মানুষে যোগাযোগ ব্যাপক হারে বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে, দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু পরিহাসের ব্যাপার হলো, আজকের পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বহুধা ধারায় বিভক্ত। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও তুলনামূলকভাবে সীমিত গণমাধ্যমের যুগে তা এমন বিভক্ত ছিল না।

উদাহরণ হিসেবে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির সময়ের কথা বলা যায়। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি গণমাধ্যমের ওপর পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠল, ওই কালাকানুন তা ঠেকাতে পারেনি। একইভাবে ১৯৮০-এর দশকে জেনারেল জিয়ার জমানায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে পরিষ্কার মতৈক্য গড়ে উঠেছিল। এরপর জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জমানায় আইনজীবীরা যে আন্দোলন গড়ে তুললেন, তা ছিল পাকিস্তানের শেষ জনসমর্থনপুষ্ট গণ-আন্দোলন। কিন্তু আজ যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিচ্যুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে এবং আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অধিকতর অনিশ্চিত, তখন কিন্তু আমরা রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মধ্যে মতৈক্য দেখছি না। তারা কিন্তু মন্থর অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অর্থপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। তারা সমন্বিত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ গভীর সামাজিক, জাতিগত, সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। সে কারণে মানুষের সমন্বিত আন্দোলন গড়ে উঠতে পারছে না।

এই পরিস্থিতির পেছনে নানাবিধ কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, গত কয়েক দশকে সংঘটিত রাজনৈতিক দলের অবক্ষয়, সেটা যেমন ডানদের বেলায় সত্য, তেমনি বামদের বেলায়ও। ২০ শতকে যে ভূম্যধিকারী শ্রেণি আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে প্রভাব বিস্তার করেছে, তারা ঐতিহাসিক কারণেই ক্ষয়ে গেছে। নব্য আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তারা যথাযথভাবে সাড়া দিতে পারছে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নানাভাবে ব্যাহত হওয়ায় তারা রাজনৈতিক মহলে এখনো প্রভাবশালী। এই ভূম্যধিকারী শ্রেণি থেকে যে রাজনৈতিক অভিজাত মহল উঠে আসে, তাদের কিছু প্রাণঘাতী আসক্তি থাকে, যেমন আমলাতন্ত্রনির্ভরতা, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি ও পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি; যার কারণে এই শ্রেণির গ্রহণযোগ্যতা বিপজ্জনকভাবে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

কৌতূহলোদ্দীপকভাবে এই রোগ কেবল সামন্তীয় পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ব্যবসায়ী ও আমলাদের মধ্যে অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হন। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে এবং তার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো যে অনেক দেরিতে সচেতন হলো, তা কিন্তু এক উদাহরণ। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিভিন্ন পেশা থেকে উঠে আসা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে জায়গা দেওয়ার ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারেনি। সে কারণে তাদের মধ্যে বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। পুরোনো বামেরা গণতান্ত্রিক ও জাতীয় প্রশ্নের সঙ্গে শ্রেণি প্রশ্নের সংযোগ ঘটাত, কিন্তু তাদের ক্ষয়ে যাওয়াটা এক বড় ধাক্কা। পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে নতুন জিহাদি দলের উত্থান এবং তারা বিপুল সম্পদ পেয়ে যাওয়ায় পুরোনো ধর্মীয় দলগুলোও পিছু হটছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আন্দোলনকে দুর্বল করতে রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র যেসব কারসাজি করছে, তাতে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে বিকৃত হয়েছে। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের সময় নির্বাচনে কারসাজি করে ফলাফল অনুকূলে রাখার যে রীতি শুরু হয়েছিল, তা এখন রীতিমতো শিল্পে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী-নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্বাচন জালিয়াতি করার ব্যাপক সক্ষমতা অর্জন করেছে। ২০০২ সালের নির্বাচনে যেসব রাজনৈতিক দলকে আসন দেওয়া হয়েছে বা যাদের সঙ্গে পারভেজ মোশাররফের যোগাযোগ ছিল, তিনি প্রকাশ্যে তাদের নাম বলেছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টেস্ট টিউব রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দল গঠনে উৎকর্ষ অর্জন করেছে। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা এদের প্রতি যেমন সমর্থন সৃষ্টি করে, তেমনি তথাকথিত বিজয়ীদের দলে ভেড়ার নির্দেশনা দেয়। আর যে রাজনীতিক ও দল রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতা দেখায়, তাদের বিরুদ্ধে ‘হন্তারক বাহিনী’ লেলিয়ে দিতে কসুর করে না এই ভেতরের রাষ্ট্র। তাদের এই কারসাজি স্বল্প মেয়াদে কার্যকর হলেও দীর্ঘ মেয়াদে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর।

এই দুঃখজনক সত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে জেনারেল আইয়ুব খানের সেই নিপীড়নমূলক দশক, যার কারণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে যায়। কিন্তু সেই দুর্যোগ থেকে পাকিস্তান কোনো শিক্ষা নেয়নি। ১৯৭০-এর দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিলেন। নিরাপত্তা বাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে এক বিতর্কিত বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর বিচার করে, যেখানে পরিষ্কারভাবে কারসাজি করা হয়েছিল। ভুট্টোর দলের ভবিষ্যৎ দুর্বল করে দিতে নিরাপত্তা বাহিনী ভাগ করে শাসন করার মতো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি করে। এটি স্বল্প মেয়াদে কাজ করলেও দীর্ঘ মেয়াদের জন্য গুরুতর সমস্যা তৈরি করে। সিন্ধুর শহরাঞ্চলে ভুট্টোর প্রভাব খাটো করার জন্য রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র মোহাজির পরিচিতির ভিত্তিতে এমকিউএম তৈরির ওপর জোর দেয়। ওই সময় সেখানে সামাজিক দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু বৃহত্তর সিন্ধু পরিচয়ের বাতাবরণে তা সমাধান করা সম্ভব ছিল; যদি গভীর রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ না করত। একইভাবে পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদ দিয়ে সেখান থেকে পিপিপিকে উৎখাতের চেষ্টা করা হয়েছে। একইভাবে রাজনৈতিক দলকে দুর্বল করার জন্য ধর্মীয় চরমপন্থা ও গোষ্ঠীগত বিভাজন কাজে লাগানো হয়েছে, যেটা স্বল্প মেয়াদে কাজে আসতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অস্তিত্বের জন্য তা হুমকিস্বরূপ।

নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদের শুধু দলের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলেই চলবে না, তাঁদের যেটা করতে হবে তা হলো, দলের ভেতরকার ক্ষয়িষ্ণু ধারা চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক দলের তত্ত্ব ও চর্চায় পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের কারসাজির বিপর্যয়কর প্রভাব হ্রাস করতে হবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য নেশন ডটকম থেকে নেওয়া।

আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনীতি বিশ্লেষক।