Thank you for trying Sticky AMP!!

গতিশীল বাস সার্ভিস ও ঢাকার যানজট

একটি নগরের বাসিন্দারা প্রতিদিন সকাল-বিকেল যাতায়াত করেন অফিস-আদালতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এবং স্কুল-কলেজে। মাঝে মাঝে যাতায়াত করেন শপিংয়ে, আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, সভা-সেমিনারে ও হাসপাতাল-ক্লিনিকে। প্রতিদিনের যাতায়াতে নগরবাসী গণপরিবহন ব্যবহার না করে যদি প্রাইভেট কার নিয়ে বের হন, তবে যানজট অসহনীয় হবেই। কারণ, দুটি প্রাইভেট কারে দুজন যাত্রী সড়কের যে জায়গা দখল করেন, সেই জায়গায় গণপরিবহনের একটি বাস জনা পঞ্চাশেক যাত্রী বহন করতে পারে। ঢাকায় গতিশীল ও নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন না থাকায় অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও তিন-চার লাখ টাকার সেকেন্ড/থার্ডহ্যান্ড গাড়ি প্রতিদিনের যাতায়াতে সড়কে নামান। অথচ প্রাইভেট কার ব্যবহার হওয়া উচিত মাঝে মাঝে যাতায়াতের ক্ষেত্রে।
ঢাকায় মেট্রোরেল/পাতালরেল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে, যা সময়সাপেক্ষ। কম সময়ে বাস-ক্যাবের মতো গণপরিবহনকে গতিশীল করা সম্ভব। ঢাকা ও আশপাশের সব বাস-ক্যাব সার্ভিসকে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির আওতায় আনা দরকার। বিনিয়োগ হবে শেয়ারে, বাসের মালিকানায় নয়। এমন উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বর্তমানে চালু সব বাস একটি নির্দিষ্ট দিন (যেমন জুন ২০১৭) থেকে সড়কে থাকবে না। সেগুলো ঢাকার বাইরে বিভিন্ন রুটে চলাচল করবে। একটি নীতিমালার মাধ্যমে বর্তমান বাসের মালিকদের ÿক্ষতিপূরণসহ উল্লিখিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার দিতে হবে। বর্তমানে চালু বাস সড়কে চালু রেখে গতিশীল গণপরিবহন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
তিন হাজার নতুন বাস উল্লিখিত দিন থেকে একযোগে সড়কে নামবে। এই প্রকল্প সার্থক করতে ভালো কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক মানের বাস লাগবে। কম দামি বাস পুরো প্রকল্প ব্যর্থ করবে। শতভাগ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস দরকার। একই রঙের, একই মডেলের বাস শহরের সৌন্দর্য রক্ষায় সহায়ক। তবে রুটভেদে বাসের নম্বর আলাদা থাকবে, যা বাসের সামনে-পেছনে দুই পাশে সহজে দৃশ্যমান হবে। পেছনের ২৫টি সিট গ্যালারি আকারে এবং সামনের ২০টি থাকবে সমান্তরাল ডেকে। সামনের সিটে প্রতিবন্ধী, সন্তানসম্ভবা, বয়স্ক ও নারীদের অগ্রাধিকার থাকবে। ২০ জনের দাঁড়িয়ে চলার ব্যবস্থা থাকবে। প্রতিটি সিটের পেছনে ঢাকা শহরের বাসের টোটাল নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম থাকবে।
বাসের সঙ্গে সড়কগুলোরও উন্নয়ন দরকার। বাসস্টপেজগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকবে। বাস থামার আলাদা লেন থাকবে। সমস্ত বাসস্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি হবে একই প্ল্যান, ডিজাইন ও নির্মাণসামগ্রীর। যাত্রী ছাউনির পেছনের ওয়ালে ঢাকা শহরের বাসের নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম বড় ম্যাপ আকারে থাকবে। সঙ্গে স্টপেজ নম্বর এবং বাস নম্বরের লিস্ট থাকবে। নামগুলো বাংলা ও ইংরেজিতে। মফস্বল থেকে ঢাকায় প্রথম আসা যে কেউ বা কোনো বিদেশিও যেন সহজে বাসের পুরো নেটওয়ার্ক বুঝতে পারেন।

>ড্রাইভারদের লাইসেন্স মান হবে ১০০। ট্রাফিক নিয়মকানুন অমান্যের কারণে বিভিন্ন মানের পয়েন্ট কাটার ব্যবস্থা থাকবে। পয়েন্ট ৩০-এর নিচে নেমে এলে লাইসেন্স বাতিল হবে এবং নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে

ঢাকার নির্ধারিত সীমানার মধ্যে একই ভাড়া নির্ধারণ করা যেতে পারে। ঢাকায় ২০ টাকা বা বৃহত্তর ঢাকায় ৫০ টাকা। বাসস্টপেজ বা বাসের মধ্যেও টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে না। এক, তিন ও ছয় মাসের পাস থাকবে বিভিন্ন রুটে, যা বাস কোম্পানির নির্ধারিত ব্যাংক ইস্যু করবে। পাসের ওপর যাত্রীর ছবি ও এক্সপায়ার তারিখটি বড় আকারে থাকবে, যেন ড্রাইভার সহজে দেখতে পান। পাস না থাকাদের জন্য বাসের টিকিট এজেন্টের মাধ্যমে যত্রতত্র পাওয়া যাবে মোবাইলের ফ্লেক্সিলোডের মতো। যেকোনো সংখ্যার টিকিট কেনা যাবে। এই পাস/টিকিট বাসে ওঠার দরজায় থাকা ডিজিটাল মেশিনে যাচাই হবে।
এই বাসগুলো হবে ওয়ানম্যান বাস, অর্থাৎ বাসে শুধু ড্রাইভার থাকবেন, হেলপার থাকবেন না। নির্ধারিত রুটের জন্য রেকর্ডেড মেসেজ থাকবে, যা যাত্রীদের স্টপেজসহ অন্যান্য নির্দেশনা দেবে। বাসে দরজা থাকবে দুটি, সামনেরটা ওঠার এবং মাঝের দরজা নামার। যেকোনো যাত্রী বাসের মধ্যে থাকা বোতাম টিপে পরবর্তী স্টপেজে নামার সংকেত দেবেন। ওয়ানম্যান সার্ভিস যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ার প্রবণতার অবসান ঘটাবে।
ঢাকা থেকে সব সিএনজিচালিত অটোরিকশা তুলে দিয়ে সমসংখ্যক সাশ্রয়ী ক্যাব নামাতে হবে। ক্যাবগুলো টেকসই মানের হতে হবে, যেন ৮-১০ বছর চালু থাকে। সঙ্গে বেশি সিসির (১৫০০ থেকে ২০০০ সিসি) পর্যাপ্ত সংখ্যার ক্যাব থাকবে। সব সিগন্যাল বাতি টাইম কাউন্টডাউন সম্পন্ন হতে হবে, যা সড়কগুলো গতিশীল রাখতে সহায়ক। সড়ক পারাপারের জন্য কয়েকটি সেকশনে পাতালপথ নির্মাণ করলে ভালো হয়। পাতালপথের প্রস্থ অন্তত চার মিটার, উচ্চতা তিন মিটার, ওপরে ওঠার জন্য স্কেলেটর এবং পর্যাপ্ত বাতির ব্যবস্থা থাকবে। সড়কের ওপর দিয়ে পারাপারের স্থলে জেব্রাক্রসিংগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকবে। জেব্রাক্রসিংয়ে সবুজ সিগন্যাল বাতির সঙ্গে একটি জনপ্রিয় গানের মিউজিক বাজবে। বাসা/কর্মস্থল থেকে বাসস্টপেজ পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটার ফুটপাত থাকা অপরিহার্য।
পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন বা নতুন লাইসেন্স নেওয়া ড্রাইভারদের জন্য বিআরটিএতে ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। কীসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, ট্রাফিক সিগন্যাল ও আইন, স্টপেজগুলোতে বাস থামানোর নির্দেশাবলি তথ্যচিত্রে থাকবে। ড্রাইভারদের লাইসেন্স মান হবে ১০০। ট্রাফিক নিয়মকানুন অমান্যের কারণে বিভিন্ন মানের পয়েন্ট কাটার ব্যবস্থা থাকবে। পয়েন্ট ৩০-এর নিচে নেমে এলে লাইসেন্স বাতিল হবে এবং নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে।
এশিয়ার সব কটি উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গাড়ির মূল্য কয়েক গুণ বেশি, যা ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ ও সারা দেশের উন্নয়ন সহায়ক নয়। একটি রিকন্ডিশনড ১৫০০ সিসির গাড়ি সাত-আট লাখ টাকা দামে মিললে ভালো হয়। তবে ঢাকা মেট্রোর নম্বরপ্লেট নিতে গাড়ির সিসিভেদে সারচার্জ আরোপ করা যেতে পারে। অর্থাৎ ঢাকায় যে গাড়ির দাম পড়বে ২২-২৩ লাখ, মফস্বল শহরে পড়বে ৭-৮ লাখ টাকা। ফলে মফস্বল শহরে ড্রাইভারদের কর্মসংস্থান বাড়বে বলে তাঁরা পরিবার নিয়ে ঢাকায় ভিড় করবেন না। মফস্বল শহরের গাড়ি ঢাকায় ঢুকতে সিসিভেদে প্রতিদিন উচ্চহারে সারচার্জ দিতে হবে।
বাস চলা রুটে রিকশা চলবে না। গতিশীল বাস-ক্যাব চালু হওয়ার পর পৃথিবীর অনেক শহরের মতো কর্মদিবসে গাড়ির নম্বরপ্লেট জোড়-বিজোড় অনুসারে জোড়-বিজোড় তারিখে ব্যবহারের পদ্ধতি ঢাকায় চালু করতে হবে। মূলত গতিশীল বাস-ক্যাব চালু এবং প্রাইভেট কারের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই যানজট নিরসনে সহায়ক হয়, যা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ও পেনাং, চীনের বেইজিং বা ভারতের দিল্লিতে দেখা যায়। তবে এ ব্যাপারে বর্তমানে ঢাকায় চালু বাস মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি প্রাইভেট গাড়ির মালিক ও সরকারি-বেসরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদেরও দেশের স্বার্থে গণপরিবহন ব্যবহারের মানসিকতা থাকতে হবে।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।