Thank you for trying Sticky AMP!!

গরুর মাংস বিক্রেতাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ

ছবি : জাহিদুল করিম

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’—এই সুবচনটি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি। কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধির দরজা খোলার পর থেকে দেখে আসছি যে আমাদের দেশে খাওয়াদাওয়ার উপাদেয় পদগুলোর তালিকায় গরুর মাংসের আসনটি মাছের চেয়ে কয়েক কাঠি ওপরে। শহরই বলুন আর গ্রামই বলুন, গো-মাংস পেলে ভূরিভোজ হয়ে যায়। আমাদের দেশে অনুষ্ঠান-আয়োজন বা বড় কোনো দাওয়াতে খাবারের মধ্যমণি সাজে গো-মাংস। হোটেল-রেস্তোরাঁয় গেলে দেখা যায়, গরুর ‘কালা ভুনা’, চাপ বা শিককাবাবের কী দাপট!

গ্রামবাংলার জিয়াফতেও নধরদেহী আস্ত ষণ্ড ফতে করে গণ্ডে পিণ্ডে ভোজ চলে। কোন বাবুর্চি গরুর মাংস ভালো রাঁধেন, মহা সমারোহে তাঁকে হায়ার করা হয়। সত্তরের দশকে গরুর মাংস এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না। বিশেষ করে মফস্বল শহর আর গ্রামগঞ্জে। তখন পাড়া বা মহল্লায় চাঁদা তুলে বিশেষ কোনো দিন গরু জবাই করে মাংস ভাগ করে নিত। আবার এমনও হতো যে মাংস বিক্রেতা নিজেই গরু কিনে কারা কারা মাংস নেবে, তাদের একটা তালিকা করত। পরে কোনো একদিন (সাধারণত শুক্রবার) গরুটি কাটাকুটি করা হতো। গো-মাংসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কাঁচাবাজারের নিয়মিত পণ্যের তালিকায় নিয়ে যায়। এখন তো শহরগুলোর অলিগলিতে গরুর মাংসের দোকান। এত সহজলভ্য যে ঘর থেক বেরিয়ে কয়েক কদম হাঁটলেই গো-মাংস। এই মাংসের উপকার আর অপকারিতা সম্পর্কেও এখন অনেকে জানে। নিয়মিত গো-মাংসভোজী অনেকেই কিন্তু স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশ সচেতন। তাঁরা জানেন, এই ‘রেড মিট’ বা ‘লাল মাংস’ কতটা ক্ষতিকর। কিন্তু যথাসময়ে লোভ সামলাতে পারেন না। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা মানুষও গো-মাংস পেলে মচকে যান। মনে মনে কিরে কেটে বলেন, ‘এই বারই শেষ, আর নয়।’ এই নয় নয় করতে করতে গলা পর্যন্ত হয়ে যায়।

তরুণ বয়সী অনেকে তো খাওয়ার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এখন না খাইলে আর কখন খামু!’

তেজস্বী কেউ কেউ হাতের গুল টিপে বলে, ‘এইটা লোহার শরীর, তোমাগো মতন তুলার শরীর না! লোহা খাইলে লোহা হজম হয়, আর তো গরুর মাংস!’

উৎসবের বিশেষ দিনগুলোতে মাংসের দোকানগুলোয় ক্রেতাদের যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়, তা তো রীতিমতো ‘বুল ফাইট’।

মুরব্বিরা বলেন, সত্তরের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে গরুর মাংস দুই-তিন টাকা সের (তখন কেজির মাপ চালু হয়নি) দরে বিক্রি হয়েছে। পরে তা ধাপে ধাপে বেড়েছে। আশির দশকেও গরুর মাংস ২০-২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। গরুর মাংসের দাম বিভিন্ন সময়ে বাড়লেও মোটামুটি একটা সহনীয় ভাব ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে দাম বাড়ার গতি পাগলা ঘোড়ার মতো লাগাম ছিঁড়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস এখন ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে—ভাবা যায়!

বলতে দ্বিধা নেই, গরুর মাংস আমারও খুব প্রিয়। বিশেষ কারণে চিকিৎসক যেদিন এই খাবারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন, সেদিন মনে হয়েছিল যে আমার গলায় যেন গরুর মতো একটা শক্ত দড়ি পরানো হলো। কাতর হয়ে জানতে চাইলাম, গরুর মাংস কি একেবারেই খাওয়া যাবে না? চিকিৎসক জানালেন, যাবে। তবে এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এরপর তিনি যে পদ্ধতি বাতলে দিলেন, তা অনেকটা ঘাস খাওয়ার মতো। সে যা-ই হোক, আমার অর্ধাঙ্গিনী বাসায় গরুর মাংস আনা একেবারেই বন্ধ করে দিল। পাছে আমি খেয়ে ফেলি—এই ভয়ে। মানুষ বেকায়দায় পড়লে সমব্যথী খোঁজে। পেয়ে গেলাম বেশ কয়েকজন। একজন জানাল, বাসায় গরুর মাংস রান্না হলে সে হাঁড়ির ঢাকনা খুলে ঘ্রাণ নেয়। কিন্তু খায় না। লুকিয়ে দু-এক দিন খেয়ে দেখেছে—চোঁ করে প্রেশার উঠে যায়। পরে যে ধকলটা যায়, তা আর কহতব্য নয়।

এভাবে একে-ওকে দেখে ধীরে ধীরে গরুর মাংস থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, গরুর মাংসের প্রতি আমার এখনো আকর্ষণ আছে। কিন্তু লোভ নেই। আমার এই সতর্কতায় ঘনিষ্ঠজনেরাও সচেতন। এমনকি ছোটরাও জানে, ‘রেড মিট’ বেশি খেতে নেই। ওতে হাই কোলেস্টেরল। বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে, এ নিয়ে আমার আপত্তি থাকলেও কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং এটা এই ক্ষতিকর খাবার থেকে আমাকে আরও দূরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করবে। এ জন্য গরুর মাংস বিক্রেতাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ!

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
sharifrari@gmail.com