Thank you for trying Sticky AMP!!

গোলমেলে মন্তব্য থেকে সাবধান!

মং জার্নি

সত্য অনেক সময় আমাদের আহত করে এ কথা জানতাম। কিন্তু মিথ্যাও যে সমানভাবে আহত করতে পারে, তা জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের এবং মিয়ানমারের রাজনীতিক ও জেনারেলদের গোলমেলে গালগল্প না শোনা পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনে নিয়োজিত জাতিসংঘের সাবেক ও বর্তমান রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটরদের সমন্বয়হীন ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তায় বিভ্রান্তি ক্রমেই সবার সামনে ভেসে উঠছে। তাঁদের কথাবার্তায় আরও জোরালোভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো কত নোংরা ও কুৎসিত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। 

ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেটর মিয়া সেপ্পো বলেছেন, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ‘কিছু অগ্রগতি’ হয়েছে। কিন্তু ইয়াঙ্গুনে একই পদে থাকা নুট ওস্টবি টুইট করে যা বলেছেন, তাঁর সঙ্গে মিয়া সেপ্পোর কথার মিল পাওয়া যাচ্ছে না। টুইটে তিনি জোরালোভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) নজরে থাকা অং সান সু চির প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের রাজনীতিকেরা তাঁদের ‘সমৃদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য আইন’ আবার ফিরিয়ে আনতে জোরালোভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বিষয়ে সু চির ওপর তাঁর আস্থা আছে। মিয়ানমারে এখনো গণহত্যা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এই অবস্থার মধ্যেই সু চি ও জেনারেলদের প্রশংসা করে নুট ওস্টবি এমন কথা বললেন।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘ভুলে যাবেন না, হিটলার সবকিছুই করেছিলেন আইনের বৈধতা নিয়ে...।’ লুথার কিং তাঁর এই কথার মর্ম খুব ভালো করেই জানতেন। এখন সু চি ও মিয়ানমারের জেনারেলরা যে ‘সমৃদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য আইন’ পুনরুজ্জীবিত করতে যাচ্ছেন, সেটি আমার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি একটিবারের জন্যও আশ্বস্ত হতে পারছি না, যখন দেখি জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত লোকজন খুব গতানুগতিকভাবে নাক গলিয়ে, খুনি ও উৎপীড়কদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তাঁদের প্রকল্প চালিয়ে যান, তখন অবিশ্বাসের বেদনায় আমি মুষড়ে পড়ি।
কয়েক মাস আগে মিয়ানমার নিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। সেখানে ইয়াঙ্গুনে রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরেন। ওই রিপোর্টে বলা হয়, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা, বিভিন্ন দেশের দূত ও অন্যান্য ব্যক্তি মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আলামত দেখেছেন। বিষয়টি জেনারেলরা এবং সু চি নিজেও ভালোভাবে নেননি। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের পরিসংখ্যানে বলা হয়, ৮০ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা শিশু না খেতে পেয়ে ‘তীব্র অপুষ্টিতে’ ভুগছে।
মিয়ানমারে যখন নিষ্ঠুর গণহত্যা চলছে, সেই মুহূর্তে আমরা দেখলাম বার্মিজ সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইংয়ের ফেসবুকে অসংখ্য ‘বিকল্প’ খবর। সেখানে তিনি খবর জানাচ্ছিলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতিটি গ্রামে অন্তত ১০০ জন আরসা সন্ত্রাসী আছে; ১০ থেকে ২০ হাজার ‘বাঙালি’ ৩০টি চেকপোস্টে হামলা চালিয়েছে এবং হিন্দু ও আদিবাসীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে। এমনকি ‘বাঙালি’ শিশুরা পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিন একটি আক্রমণাত্মক প্রতিবেদন ছেপেছে। এতে বলা হয়েছে, মাত্র ১০০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এমন নিষ্ঠুর গণহত্যা চালানো হয়েছে যে সেখানে ৪৩ হাজার বাবা-মা প্রাণ হারিয়েছেন। লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের শিক্ষক লি জোন্স মিয়ানমারকে ‘গণহত্যার কারখানা’ বলে উপহাস করেছেন।
গণহত্যা চালানো শাসকগোষ্ঠী চিরকালই বিশ্বকে ‘বিকল্প ঘটনা’, যেটিকে বলা যায় ‘নির্জলা মিথ্যা’ খবর দেওয়ার চেষ্টা করে এসেছে। রুয়ান্ডায় হুতিরা তুতসিদের ওপর গণহত্যা চালানোর পর সিএনএনের প্রথম দল যখন সেখানে পৌঁছাল, তখন হুতিরা সিএনএনকে বলল, ‘তুতসিরা নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলেছে।’
আমি সু চি ও তাঁর বাবার প্রতিনিধিদের, মানে জেনারেলদের (যাঁদের প্রতি সু চির সত্যিকারের মায়া-মমতা আছে) কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না। ইতিমধ্যে সু চি বার্মিজ মিলিটারির কঠোরভাবে ‘সন্ত্রাসীদের’ দমনকে ‘ভালো কাজ’ বলে রায় দিয়েছেন। সেনাদের ‘সাফল্যকে’ স্বাগত জানিয়েছেন। ভারতের ‘হিন্দু তালেবান’ মোদির সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের মাটিতে সন্ত্রাসীদের ‘শিকড় গাড়তে’ দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
সু চি ও জেনারেলদের কাছে সত্য কথা আশা করা না গেলেও আমি অন্তত জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে উচ্চমানের সমন্বয়পূর্ণ গ্রহণযোগ্য কথা আশা করেছিলাম। কিন্তু হায়! তাঁদের কথাবার্তায় জাতিসংঘ এখানে কী কারণে এসেছে, তাদের কাজটা কী-সে বিষয়টাই আমার কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে। একজন সমন্বয়কের কথার সঙ্গে আরেকজন সমন্বয়কের কথার মিল থাকছে না। পরস্পরবিরোধী গোলমেলে বক্তব্য আমাদের বিভ্রান্ত করে ফেলছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মং জার্নি পাশ্চাত্য প্রবাসী, মিয়ানমারের মানবাধিকার কর্মী ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ