Thank you for trying Sticky AMP!!

গ্যাং কালচার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত 'অপরাধী'রা

কিশোর বয়সী ছেলেরা এ রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাতে এদের পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী?

গ্যাং কালচারের হাত থেকে যেন রেহাই নেই, তাদের উপদ্রব আবারও বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। গত বছরের ৬ জানুয়ারি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের কাছে সন্ধ্যাবেলা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সে-ও এক গ্যাংয়ের সদস্য ছিল, খুন হয়েছিল আরেক গ্যাংয়ের হাতে। সম্প্রতি খুনি গ্যাংয়ের সদস্যরা আদনানের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয়। পরিণামে আদনানের পরিবার এখন একরকম উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছে। 

পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না বা আসামিরা জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা আইনশৃঙ্খলাজনিত ব্যাপার, কিন্তু এর একটা সামাজিক দিকও আছে। কথা হচ্ছে, এই কিশোর বয়সী ছেলেরা এ রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে এদের পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী। ‘নৃশংসতার চর্চা বাস্তবে, ভার্চ্যুয়াল জগতে’ শীর্ষক সংবাদে জামিনে মুক্তি পাওয়া এক কিশোরের বাবা বলেছেন, ‘আমার ছেলেটার মাথা গরম। কেউ বেয়াদবি করলে সহ্য করতে পারে না। ইংরেজি ভার্সন থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অনেকে তার সঙ্গে চলে। এইটা অন্যদের সহ্য হয় না। তারাই ফাঁসায়।’ কথাটা স্বাভাবিক পিতৃসুলভ, যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, পরিবারে অশান্তি আছে। কিন্তু তাতে একটা গভীর ব্যাপার জড়িয়ে আছে। সেটা হলো, সন্তান লালন-পালনের সময় কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়—সে বিষয়ে অভিভাবকের সম্যক ধারণা থাকাটা জরুরি। এটা যে একটি বিজ্ঞান বা শাস্ত্র হতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে। ইদানীং পশ্চিমা দেশে এসব বিষয়ে কিছু ওয়েবসাইট গড়ে উঠেছে। সেখানে ঢুঁ মারলে বোঝা যায়, ব্যাপারটা কত জটিল ও সূক্ষ্ম। সন্তানের সামনে কখন কী করা উচিত আর কী উচিত নয়, কী করলে তার কচি মনে কী প্রভাব পড়ে—এসব যে বিবেচনার বিষয় তা এখনো আমাদের সমাজের বহু মানুষ জানে না। এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষেরাও এ বিষয়ে অবগত নয়। পিতারা মনে করেন, টাকা উপার্জন করে সন্তানের চাহিদা মেটালেই তাঁর কাজ শেষ। কিন্তু বিভিন্ন বয়সে সন্তানের যে বিভিন্ন মানসিক চাহিদা থাকতে পারে, তার খবর কজন রাখেন। তাই দেখা যায়, কিশোর ছেলে মেয়েরা রাত ১০টা পর্যন্ত আড্ডা মারছে।
আরেকটি বিষয় হলো, ১৯৯০-এর দশক থেকে দেশে ব্যাপক গতিতে নগরায়ণ হচ্ছে। গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে যারা বড় শহরে আসছেন, তারা একরকম উন্মূল হয়ে পড়ছেন। সেখানে তাদের সমাজ গড়ে উঠছে না। আবার দলে দলে মানুষ শহরে আসার কারণে শহরের যে সমাজটা একসময় গড়ে উঠেছিল, গত ২৮ বছরে সেই সমাজের রূপটা ভেঙে গেছে। ফলে তাদের অবস্থা হয়েছে না ঘরকা, না ঘাটকা—ঘরেরও নয়, পরেরও নয়। ফলে সমাজে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যার কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক মূল্যবোধ। আবার যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়াতেও শিশু-কিশোরেরা পারিবারিক মমতা বা আবহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া সমাজের গতিধারায় হয়তো অনিবার্য বিষয়, কিন্তু তার বিকল্প আমরা বের করতে পারিনি। আর আমাদের শহরও এমন কদাকার, যেখান থেকে অভিন্ন পরিসরগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে বিকেলবেলা পাড়ার ছেলে-বুড়োদের একত্র হওয়ার অবকাশ নেই। মাঠ বা খালি রেখে লাভ কী, মার্কেট বানালে পকেট টাকায় ভরে যাবে।
ভয় দেখিয়ে উত্তরার এই কিশোরদের হয়তো ক্ষণিকের জন্য নিবৃত্ত করা যাবে, কিন্তু ওদের তৎপরতা চিরতরে বন্ধ করা যাবে না। সমাজের মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন না এলে বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না হলে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। একই সঙ্গে অভিভাবকদের উচিত, সন্তানদের সময় দেওয়া, শুধু টাকা দিলেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মানুষের সামাজিকায়ন বা শিক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। তাই এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরপর চলে আসে বিদ্যালয়ের কথা। জিপিএ-৫ পাওয়ার বিদ্যার সঙ্গে যদি শিশু-কিশোরেরা সামাজিকতা, নৈতিকতা, বিবেকের শিক্ষা না পায়, তাহলে হয়তো আরও অনেক আদনানের মৃত্যু আমাদের দেখতে হবে। একই সঙ্গে স্কুলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও থাকা উচিত, কারণ, কিশোর বয়সে মানুষের চিন্তার জগতে বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যেটা তাকে এলোমেলো করে দেয়।
কথা হচ্ছে, আদনানের খুনি কিশোরদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জিপিএ-৫ পেয়েছে বা পাবে, কিন্তু এই জিপিএ-৫ লইয়া আমরা কী করিব!

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক।