Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘটনা ঘটলে পুরো জাতি সোচ্চার হই, পরে ভুলে যাই

এ এন এম মুনিরুজ্জামান

বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মতৎপরতার কারণে বাহ্যিক ঝুঁকি আপাতত কিছুদিন স্তিমিত থাকলেও বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের যে হুমকি বা ঝুঁকি, সেটা কোনো অংশে কমেনি। বিশেষ করে সিরিয়া থেকে দায়েশ বা আইএস বিতাড়িত হলেও তাদের মতবাদ কোনোভাবে শেষ হয়নি। বরং সমস্যাটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে অনেকাংশে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়াও স্বাভাবিক।

আমরা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারছি, আমাদের বড় একটা হুমকি আসতে পারে লোন উলফ বা ছোট সেলের দ্বারা পরিচালিত কোনো হামলার মাধ্যমে। অনলাইনে জঙ্গিদের যে ধরনের কথাবার্তা দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তারা লোন উলফ টাইপের হামলার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে হোলি আর্টিজান বেকারির মতো বড় ধরনের হামলা করাটা কঠিন হবে। লোন উলফ হামলা করাটা দুরূহ ব্যাপার নয়। তাই ঝুঁকি মোকাবিলায় আগের চেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

এ ছাড়া আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখার (একিউআইএস) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি নতুন করে নজর দেওয়া হচ্ছে। তাদের তৎপরতা অনেকটা বৃদ্ধি পাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যাটা দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে এখানে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীর নজর দেওয়াটা স্বাভাবিক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, এখানে কোনো জঙ্গি সংগঠন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করলে সেটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা কঠিন হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে কিশোর-তরুণ গোষ্ঠী বেড়ে উঠছে, তাদের মনে যে ক্ষত রয়েছে; তাদের আকর্ষণ করাটা জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে সহজ হবে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মি যে ধরনের অভিযান চালাচ্ছে, তাদের জন্য তারা নতুন সদস্য সংগ্রহের জায়গা খুঁজবে এবং চেষ্টা চালাবে। আরাকান আর্মির নজরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়তে পারে বলে আমি আশঙ্কা করি। তাই আমরা মনে ক​রি, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

বিশেষায়িত কিছু দিক আছে, যেখানে আমাদের হুমকি আছে বা দুর্বলতা আছে। এর মধ্যে উল্লেখ করতে চাই, আমাদের কারা ব্যবস্থায় বর্তমানে যে ধরনের পরিস্থিতি আছে, তাতে সেখানে যারা যাচ্ছে, তারা শুধু আরও বড় ধরনের জঙ্গি হয়ে বেরিয়ে আসছে না; বরং তারা তাদের সঙ্গে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করে নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে। পরে বেরিয়ে এসে নতুন নতুন জঙ্গি সেল করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। কাজেই কারাগারের ভেতরে জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড প্রচারের যে ধরনের সুযোগ রয়ে গেছে, সেটা বন্ধ করার কোনো সক্ষমতা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। কারণ, কারাগারে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশনের কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই।

আমাদের নারীদের একটা অংশের মধ্যে উগ্রবাদ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটাকে গতানুগতিকভাবে মোকাবিলা করা যাবে না। সাধারণত যেভাবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করে থাকি, নারী জঙ্গিদের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি নেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু নতুন কৌশল নিতে হবে।

আমাদের তরুণসমাজ নানা ধরনের অস্থিরতার মধ্যে আছে। তাদের সঠিকভাবে পরিচালনার অভাব দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাদকের প্রভাব। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যুব সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ করেছিলাম। সেখানে তারা বলেছিল, ভবিষ্যতের সঠিক পথ দেখানোর মতো কাউকে তারা ​দেখে না। জীবনের রোল মডেল হিসেবে মেনে নিতে পারে, এমন কাউকে এখন তারা দেখে না। এ ছাড়া আমাদের সমীক্ষায় এসেছিল, তরুণেরা একটা ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। এদের ভেতর থেকে উল্টো পথে চলে যাওয়ার বেশি আশঙ্কা আছে। এর আগে গেছেও; হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বিষয়টি বড় করে প্রকাশ পায়।

আমাদের সমস্যাটা হলো, যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তখন অল্প কিছুদিনের জন্য পুরো জাতি সোচ্চার হয়ে উঠি। এর কয়েক মাসের মধ্যে বিষয়টা ভুলে যাই, যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন আরেকটা ঘটনা ঘটে।

আমরা বিভিন্ন স্তরে বিশ্লেষণ করে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের প্রতি যে হুমকি বা ঝুঁকিগুলো ছিল, সেগুলো নতুন রূপে বা নতুন আঙ্গিকে আসার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আমাদের নতুন করে বিশ্লেষণের পর এগুলোকে প্রতিহত করার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে।

এখানে একটা কথা বলতে চাই, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আমরা সাময়িকভাবে অনেক সাফল্য পেয়েছি। জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমাদের সার্বিক যে দুর্বলতা, সমীক্ষা করে সেটা বের করতে হবে। আমি মনে করি, জঙ্গিবাদ একটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। একটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য চেষ্টা থাকতে হবে। সেদিক থেকে আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে এখনো। আর বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের (কাউন্টার টেররিজম) জন্য যে জাতীয় কৌশলগত অবকাঠামো থাকা দরকার, সেটা আমরা তৈরি করিনি। জাতীয় কাউন্টার টেররিজম কৌশলপত্র আমাদের প্রণয়ন করার কথা, সেটা আমরা এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখতে পাইনি। যারা উগ্র পথে চলে গেছে, তাদের ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার কোনো কৌশল বা পুনর্বাসন কর্মসূচি আমাদের নেই।

আমি যে ধরনের জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় অবকাঠামোর কথা বলছি, সেটার বিভিন্ন স্তরে এসব বিষয়ে নীতিমালা ও কার্যক্রম থাকতে হবে। তা না হলে কোনো দিন দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে যেতে পারব না। হয়তো সমস্যাটা সাময়িকভাবে স্তিমিত রাখতে পারব; কিছুদিন পর দেখা যাবে, আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আশা করব, সবার অভিজ্ঞতা দিয়ে, আমাদের প্রয়োজনে একটা জাতীয় অবকাঠামো গড়ে তুলব; যাতে প্রয়োজনীয় সব কৌশলগত নীতিমালা থাকবে।

 সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ