Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘটনা পুরোনো হলে অভিযোগ খারিজ হয় না

‘আমি আমার কথা প্রকাশ করতে চাই, অনেক দিন ধরেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, দেনদরবার করছি, অন্যরা যখন পারছে, আমি কেন দাঁড়াতে পারছি না আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে। প্রতিদিনই নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করছি। কী ধরনের ঝড় আমার ওপর বয়ে যেতে পারে, সেগুলো প্রতিদিন নোট করছি। এ পর্যন্ত যাঁরা মুখ খুলেছেন, তাঁদের স্ট্যাটাসের নিচের মন্তব্যগুলো প্রতিদিন কয়েকবার পড়ছি। আমি যদি আমার বিভাগের সেই শিক্ষকের কথা প্রকাশ করি, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সাবেক বিভাগের শিক্ষকদের অনেকের মাথায় হাত পড়বে, বিস্ময়ে চোখ কপাল ছুঁতে চাইবে। অনেকই হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না, কারণ সেই বিভাগে সেই শিক্ষকের ইমেজ একেবারেই ভিন্ন। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, এই মি টু আন্দোলনের কারণে সেই শিক্ষক মনে হয় রাতে সঠিকভাবে ঘুমাতে পারছেন না। কিন্তু সেই শিক্ষককেই হয়তো সমর্থন দেবে বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু সেই শিক্ষকের জন্যই আমি আমার অতি প্রিয় বিভাগে যেতে ভয় পাই এখনো। তবু বলতে চাই, সাহসের ওপর ভর করে সত্য প্রকাশ করতে চাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক ছাত্রী কয়েক দিন আগে আমার ইনবক্সে এ কথাগুলো লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এ ধরনের অভিযোগ এর আগে শুনিনি, তা নয়। কারও কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এত বেশি যে সেগুলো ‘সবাই জানে’ টাইপে পরিণত হয়েছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও সেটি ঘটনা হিসেবে একবারেই নগণ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত মি টু আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই পর্যন্ত বেশ কয়েকজন নারী মুখ খুলেছেন বাংলাদেশে। অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে উঠেছে, তাঁরা সবাই কমবেশি পরিচিত মুখ—সাংবাদিক, নাট্যাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আবৃত্তিশিল্পী, প্রকাশক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তবে মুখ খোলার অপেক্ষায় আছেন আরও অনেকেই। প্রায় প্রতিদিনই দু-চারজন নারীর সঙ্গে ফেসবুকে ইনবক্সে কথা হয়, তাঁরাও কমবেশি জানাতে চান, একটু একটু করে সাহস সঞ্চয় করছেন। কেউ কেউ মুখ খুলতে চাইছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিরুদ্ধে, কেউ কেউ চাইছেন আত্মীয়স্বজন এবং কাছের মানুষের বিরুদ্ধেই।

তাঁদের সাহস, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার শক্তি আর মনোবল দেখে আমি নিজে কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছি। কারণ, আমি নিজেও নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি অনবরত আর মনে মনে যেসব নারী মুখ খুলেছেন, তাঁদের ঈর্ষা করছি।

তাঁদের অভিযোগের বিপরীতে যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হলো এত দিন পর কেন? তখন কেন বলা হলো না? এত দিন পর এ ঘটনা নিয়ে কথা বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ কাছে, রাজনীতি আছে। এমন ভাব যেন সে সময় অভিযোগটি উত্থাপিত হলেই তিনি অভিযোগটি স্বীকার করে নিতেন, কিংবা অভিযোগ যে মিথ্যা, সেটি প্রমাণ করা যেত, যা এখন করতে পারছেন না। কিংবা তাঁরা কি মনে করছেন সময়ের হিসাব ধরে ঘটনার সত্য-মিথ্যা প্রমাণিত হয়? কিংবা মৃত হলেই অভিযোগটিও মৃত হয়ে যায়? মৃত্যুর পর বিখ্যাতজনদের মহান কীর্তিগুলো যেমন টিকে থাকে, তেমনি মৃত্যুর পর তাঁদের যৌন নিপীড়নের ইতিহাস টিকে থাকার কথা। মানুষ বিখ্যাত হলেই তার অপরাধের শাস্তি কম হবে? কিংবা যৌন হয়রানির মতো অপরাধ সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে বৈধ হয়ে যায় কি?

মি টু বিষয়ে ভাগ হচ্ছেন মানুষজন। যখন একেকজন নারী মুখ খুলছেন, তখনই বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন তাঁর আশপাশের মানুষজন। আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, সেটি হলো যখন আমাদের কাছের কেউ কিংবা বন্ধুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তখন আমরা নানাভাবে তাঁর পক্ষ নিই। তাঁকে কে কত বছর ধরে চেনেন, কিংবা তিনি কতটা কাছের, তিনি কতটা দেবতুল্য, সেই নিরিখে সেই ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি আমাদের ঘনিষ্ঠ হলে অভিযোগ বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রমাণ করার জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে ধরো তক্তা, মারো পেরেকের মতো অবস্থা। পারলে এখনই ফাঁসিতে ঝোলাই। এমনকি এই প্রশ্নও এসেছে একজন অভিযোগকারীর বিষয়ে যে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়ে চুপচাপ ছিলেন, কিন্তু এখন কেন অভিযোগ করছেন?

আরেকটি দিক হলো, অভিযোগকারীর সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রেমের সম্পর্ক প্রমাণ করার চেষ্টা এবং সেই সূত্রে যৌন হয়রানি জায়েজ করার চেষ্টা। প্রেমের সম্পর্ক
থাকলেই সবকিছু বৈধ হয়ে যাবে, সম্পর্ক থাকলেই যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলা যাবে না, এমন নয়। আর প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যাঁরা অনেকটাই পরিচিত মুখ, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণ ব্যক্তিগত ঈর্ষা। যাঁদের বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের দু-চারজনের বিষয়ে এ ধরনের অভিযোগ আরও অনেক শোনা গেছে। ঘটনার বয়স যত বছরই হোক না কেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি যত বড় সেলিব্রেটি হোন না কেন, তাঁর সঙ্গে অপরাধ ক্ষমা করার যোগসূত্র নেই। অভিযোগকারী কেন এখন বলছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি বেঁচে থাকতে কেন বলেননি—যাঁরা এই প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা একবারও ভাবছেন না অভিযোগকারীরা আইনের মাধ্যমে বিচার চাইছেন না। তাঁরা ভয়হীন জীবনের জন্য লড়ছেন, অন্যের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরির জন্য লড়ছেন। অনভিপ্রেত ঘটনায় অসম্মানে সাময়িক কুঁচকে যাওয়া মেয়েটি একটু একটু করে সাহস তৈরি করছে, হয়তো এরও আগে অনেকবার চেষ্টা করেছে, বলতে পারেনি, জানাতে পারেনি। নিজের ভয় কাটাতে সময় লেগেছে, ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটাতে সময় লেগেছে। নিজের মতো করে পরিবেশ ভাবতে সময় লাগে। তাই এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কেন তখন করলেন না কিংবা এখন করছেন কেন—এগুলো একেবারেই গুরুত্বহীন প্রসঙ্গ।

অসীম সাহসে ভর দিয়ে ঈর্ষণীয়ভাবে নারীরা অনেক আগের ঘটনারই জবানবন্দি দিচ্ছেন, এতে আছে যৌন হয়রানির মতো ভয়ংকর অপরাধকে চিহ্নিত করার তাগাদা। হ্যাশট্যাগ মি টু যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীর সাহসী হওয়ার আন্দোলন, পৌরুষদীপ্ততার ঝাপটাকে ঝাঁকিয়ে দেওয়ার আন্দোলন। আমিসহ এ দেশের যৌন হয়রানির শিকার হওয়া প্রত্যেক নারীর মুখ খোলার সময় এসেছে নিশ্চিতভাবেই।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক

zobaidanasreen@gmail.com