Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘটিবাটি নয়, বই

প্রথমেই সব স্কুলের শিক্ষক এবং কর্তাদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দিই। স্কুলে প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে ঘটিবাটি দেওয়া যাবে না। দিতে হবে মানসম্মত বই, কিংবা শিক্ষা উপকরণ। সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ধন্যবাদার্হ। ২৪ এপ্রিল ২০১৯ পরিচালক (মাধ্যমিক) মো. আবদুল মান্নান একটা পরিপত্র জারি করেছেন। জানিয়েছেন, স্কুলগুলোয় সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ দেওয়া যাবে না। দিতে হবে বই বা শিক্ষা উপকরণ। আমরা এই ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাই।

২৩ এপ্রিল ছিল বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মৃত্যুদিন, এক ক্যালেন্ডার অনুসারে সারভেন্তেসেরও মৃত্যুদিন ২৩ এপ্রিল—ইউনেসকো এই দিনটাকে বই দিবস হিসেবে পালন করে। পালন করে কপিরাইট দিবস হিসেবেও। বই দিবসের পরের দিন এই রকমের একটা ইতিবাচক ঘোষণা যে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এসেছে, তা বিশেষভাবে অভিনন্দনযোগ্য।

এর পাশাপাশি আমার নিজের দুটো আবেদন আছে। এক, কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ বা আমন্ত্রণ করা হলে দয়া করে আমাকে কোনো ক্রেস্ট দেবেন না। কোনো কিছু না দেওয়া হলেও আমি খুশি থাকি। কিন্তু আপনাদের যদি তহবিল থাকেই, তাহলে দয়া করে বই দিন।

গত পরশু গিয়েছিলাম ক্রাউন সিমেন্ট ও প্রথম আলো আয়োজিত তারুণ্যের জয়োৎসবে। প্রায় পাঁচ হাজার ছেলেমেয়ে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সারা দিন ধরে অংশ নিয়েছে এই উৎসবে, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের জীবন ও জীবিকা গড়তে পথের সন্ধান দেওয়া। ৫০ জন বক্তা বিভিন্ন ভাগে ও ভাবে কথা বলেছেন, ২০টি স্টল ছিল। আমিও ছিলাম একটা আলোচনার সঞ্চালক। পর্ব শেষে বক্তাদের হাতে একটা করে ব্যাগ তুলে দেওয়া হলো। তাতে ছিল কিছু স্মারক আর চারটি করে বই। আমি খুবই খুশি।

তারুণ্যের জয়োৎসবের এই আয়োজন থেকে তরুণ-তরুণীরা প্রেরণা পাবে, দিশা পাবে নানাভাবে; কিন্তু আমি নিয়ে এসেছি দুটো শিক্ষা। এক, পুরো অনুষ্ঠানটি হয়েছে বাংলায়। এর শিরোনাম বাংলায়; এর মূলবাণী বাংলায়, ‘পথ ঘোরাও নিজের পথে’। দুই, বক্তাদের হাতে উপহার হিসেবে ক্রেস্ট দেওয়া হয়নি, বই দেওয়া হয়েছে। আমার ভাগে যে চারটি বই পড়েছে, তার সবই আমি বইমেলা থেকে কিনে এনেছি, তা সত্ত্বেও আমি খুশি। বই কখনো উদ্বৃত্ত হয় না। বই কখনো পুরোনো হয় না। কাজের বই সব সময়ই আমি দুই কপি, তিন কপি করে রাখি, আর তারপরও থাকে অন্যকে উপহার দেওয়ার সুযোগ। কিন্তু ক্রেস্ট দিয়ে আমি কী করব?

আর আসুন, আমরা শিক্ষার্থীদের সব অনুষ্ঠানে পুরস্কার হিসেবে বই উপহার দিই। অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও উপহার হিসেবে বই দেওয়ার একদা প্রচলিত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনি।

আর বলছিলাম অনুষ্ঠানের নামকরণ, প্রকাশনা, প্রচারণা ইত্যাদি বাংলায় করার কথা। একবার একটা অনুষ্ঠানে গেছি। ঢাকা শহরের একটা পাঁচতারা হোটেলে হচ্ছে অনুষ্ঠানটি। অংশ নিতে সারা দেশ থেকে এসেছে শ চারেক তরুণ-তরুণী। তাদের বলা হবে, (ধরা যাক) ইভ টিজিং যেন সমাজে বন্ধ হয়, সে জন্য কী করতে হবে, এ বিষয়ে। দাতাদের কাছ থেকে তহবিল পাওয়া গেছে, তাই এ অনুষ্ঠান। সেখানে ৪২৫ জন উপস্থিত, ৪২৪ জন বাংলা ভাষায় কথা বলে, একজন এসেছেন দাতা সংস্থা থেকে, তিনি ফিলিপাইনের। শুধু এই একজন বিদেশির জন্য পুরো অনুষ্ঠান পরিচালিত ও পরিবেশিত হচ্ছে ইংরেজিতে। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে, মোবাইল ফোনে ফেসবুকিং করছে, উসখুস করছে। কারণ, ওই পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনও তাদের টানছে না, বক্তাদের ইংরেজিতে বলার করুণ চেষ্টায় মন দিলে তারা বরং করুণাই বোধ করত। আমি যখন বাংলায় কথা বলা শুরু করলাম, সব ছেলেমেয়ে নড়েচড়ে বসল। আমার ধারণা, তারা আমার কথা শুনল। এখন এই অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য যদি হয় গ্রামগঞ্জ থেকে আসা ছেলেমেয়েরা, কেন তাদের উদ্দেশে কষ্ট করে ইংরেজিতে বলতে হবে? কেন এই ধরনের অনুষ্ঠানের নাম, প্রকাশনা, নিমন্ত্রণপত্র, স্মরণিকা ইংরেজিতে হবে? যদি বাংলা মাধ্যম এবং ইংরেজি মাধ্যম দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকে, তাহলে সবকিছু দ্বিভাষিক হতে পারে। কিন্তু শুধু ইংরেজি কেন?

একটা সহজ উদাহরণ দিই। গ্রামীণফোন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল ফোন কোম্পানি। পরে একটেল তার নামধাম বদলে হলো রবি। এগুলো কিন্তু গবেষণা করেই করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষাতেই কেবল স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিতে পারে। বাংলা সংস্কৃতি আমাদের ডিএনএর মধ্যে নিহিত।

বই দিবসে আছে আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কপিরাইট। আমাদের দেশে আমরা কপিরাইট কিংবা মেধাস্বত্ব বিষয়ে মোটেও সচেতন নই। এই নিয়ে আমাদের কোনো শিক্ষাও নেই। সরকারের কপিরাইট নিবন্ধন অফিস আছে। আমাদের বই, গান, নাটক ইত্যাদি কপিরাইটের জন্য নিবন্ধিত করতে হয়। আমরা যেমন নিজেদের কাজ নিবন্ধিত করে রাখি না, তেমনি অন্যদের বই, গান, সুর ইত্যাদি যখন যেভাবে পারি, ব্যবহার করি; চালিয়ে দিই। আমাদের ফুটপাত পাইরেটেড বইয়ে ভরা, আগে যেমন ছিল বিদেশি গান, ছবি ইত্যাদির ক্যাসেট কিংবা সিডি। আমাদের শিল্পীরা তাঁদের গানের রয়্যালটি পান না, আমাদের চলচ্চিত্রনির্মাতারা সদা আতঙ্কে থাকেন, এই বুঝি তাঁদের কাজ কপি করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয়।

দুই তরফ থেকেই সচেতনতা লাগবে। যাঁরা নির্মাণ করেন তাঁদেরও; আর যাঁরা ভোক্তা তাঁদেরও। আমাদের কম্পিউটার ইত্যাদিতে পাইরেটেড সফটওয়্যার, আমাদের উচ্চশিক্ষায় পাইরেটেড বইয়ের ব্যবহার এত দিন হয়ে এসেছে দেদার। কিন্তু দিন পাল্টে যাচ্ছে। এখন আমাদের বৈধভাবে সবকিছু করতে হবে। আমরা এত দিন বিদেশি বই অনুমতি ছাড়াই অনুবাদ করে বের করেছি। এটা আমরা করতে পারি না। আজকাল কোনো কোনো প্রকাশক বৈধভাবে অনুমতি নিয়ে এসে অনুবাদের বই বের করছেন বটে। তা-ই করতে হবে।

আর আসুন, আমরা বইভিত্তিক একটা সমাজ গড়ে তুলি। সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো, বই হাতে একজন মানুষ। সবচেয়ে স্মার্ট ব্যক্তি, সুন্দর মানুষ তিনিই, যাঁর হাতে বই থাকে। সবচেয়ে সুন্দর উপহার হলো বই। আমার আব্বা বলতেন, চুপচাপ বসে থেকো না। একটা বই পড়ো। যেকোনো বই। পৃথিবীতে খারাপ বই বলতে কিছু নেই। তা-ই তো। কত বিচিত্র বইয়ের সংস্পর্শেই না এলাম এই জীবনে। খুব ছোটবেলায় হাতে পেয়েছিলাম একেবারে বড়দের বই। সেটা পড়ে কিন্তু মন কলুষিত হয়নি, কারণ ব্যাখ্যা করে নিয়েছিলাম নিজের বয়সের উপযোগী করে। তেমনি বটতলার বই, কুসংস্কারের বইও তো পড়েছি। কোন স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা, হাতের রেখা—এগুলোর কোনো প্রভাবই তো মনে স্থায়ী হয়নি।

কিন্তু সেই যে ছোটবেলায় পুরস্কার হিসেবে হাতে এসেছিল গল্পগুচ্ছ, সঞ্চিতা, আরেকটু বড় হয়ে হাতে পেয়েছিলাম দুনিয়া কাঁপানো দশদিন, বোনের জন্মদিনে তিনি পেয়েছিলেন শামসুর রাহমানের দুঃসময়ে মুখোমুখি; পিটিআইয়ের লাইব্রেরি থেকে এনে পড়তাম দেবসাহিত্য কুটিরের রঙিন বইগুলো; রুশ দেশের উপকথা, উভচর মানুষ, ইস্পাত; জসীমউদ্দীনের বোবাকাহিনি, শওকত ওসমানের ওটেন সাহেবের বাংলো, রাহাত খানের দিলুর গল্প, কিংবা বড় ভাইবোনের দ্রুত পঠন কথা বিচিত্রার গল্পগুলো—সেগুলোই তো মনের মধ্যে গেঁথে আছে। খারাপ বই বলতে তা কিছু পড়েছি বলে আর মনেও পড়ে না।

কাজেই স্কুলগুলোয় যে পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই আহ্বানটা যেন বৃথা না যায়। বই, একটু মানসম্পন্ন বই। একটা থালা দেওয়া মানে থালাই দেওয়া। ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেওয়া মানে একটা পরশপাথর তুলে দেওয়া; এই একটা বই ওর জগৎ পাল্টে দিতে পারে। আরেকটা কথা। ই-বই, কিন্ডল ইত্যাদির একটা চল পশ্চিমে এসেছিল। পশ্চিমারা আবার কাগজের বইয়ে ফিরছে। আমরা যদি মাথা নিচু প্রজন্ম না চাই, তাহলে আমাদের কাগজের বইকেই উৎসাহিত করতে হবে। কাগজের বই আছে, আরও বেশ কিছুদিন থাকবে। ছেলেমেয়েদের হাতে তাই বই-ই তুলে দিন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক