Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘাতকেরা ক্যাম্পাসগুলোকেই বেছে নিচ্ছে

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি, নিজের ক্যাম্পাসেই হামলাকারীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আরও জেনেছি, ঘাতকের আঘাতের আগে তিনি নিজ বিভাগের একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিলেন। আগেও ধর্মীয় জঙ্গিবাদী গ্রুপ থেকে কয়েক দফা জাফর ইকবালকে হুমকি দেওয়া হয় এবং এরই ভিত্তিতে তাঁকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেহরক্ষীও দেওয়া হয়। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, হামলাকারী তার পেছনেই ছিল, সেখান থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, আক্রমণকারীর মূল উদ্দেশ্য ছিল জাফর ইকবালকে হত্যা করা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে তাঁর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় সঙ্গে থাকা পুলিশও সেখানে ছিল। এরপরও রক্ষা পেলেন না মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁকে আঘাতকারী ব্যক্তিও ধরা পড়েছেন, তাঁকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হামলাকারী ফয়জুর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাশেই থাকতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধীরে ধীরে ঘাতকের আবাসভূমিতে পরিণত হচ্ছে, অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হওয়ার কথা ছিল সবার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, যেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা স্বাধীনভাবে শিক্ষা ও শিক্ষাজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ে তাঁদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবেন। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই আক্রান্ত হচ্ছে পরপর। মুক্তবুদ্ধি ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ছাত্র-শিক্ষকদের জীবন অনেকটাই এখন সন্ধিক্ষণে। যেকোনো সময়ে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। সবার মধ্যেই একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার/আপনাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঘাতকের উপস্থিতি প্রথম টের পাওয়া যায় ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতেই সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। তিনি তাঁর ওপর হামলার জন্য নিজেই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে দায়ী করেছিলেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রক্তভেজা ছবি আজও ক্যাম্পাসে ঘাতকদের বিরতিহীন উপস্থিতিই মনে করায় এবং যার প্রমাণ মেলে পরবর্তী সময়েও। ২০১৫ সালে আবারও ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছেই হত্যার শিকার হন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই বড় হওয়া বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়। একই বছরের ৩১ অক্টোবর একই কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই শাহবাগে খুন করা হয় আরেক ক্যাম্পাস-সন্তান প্রকাশক ফয়সল আরেফিনকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে এ ধরনের ‘টার্গেট কিলিং’ কিংবা এ ধরনের হত্যাচেষ্টা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কয়েকটি টার্গেট কিলিং হয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে পরপর হত্যা করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার বাসা থেকে ৩০০ গজ দূরে ঘাতকদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক ইউনুস। এর দুই বছর পর ২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক এস তাহেরকে খুন করা হয়। এরপর কিছুটা বিরতি দিয়ে ২০১৪ সালে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এ কে এম শফিউল ইসলামকে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে খুন করা হয়। সেই সময় সারা দেশে ব্লগার হত্যার আঘাতের ধরনের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী (৫৮) হত্যার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ইসলামি চরমপন্থীদের হাতে তিনি খুন হন। সর্বশেষ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা থেকে আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি। এর মাধ্যমে একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন মেধাবী শিক্ষকদের হারাচ্ছে, তেমনি প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনিরাপত্তার ভয় জারি থাকছে। তবে অনিরাপদ ক্যাম্পাসই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবতা হয়ে গেছে?

দুই.
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর সব ক্যাম্পাসেই সবাই কষ্ট, ক্ষোভ, ভয় ও আতঙ্কে আছেন। গত কয়েক বছরে ইসলামি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকির কারণে ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক দেশত্যাগ করেছেন। যেখানে জাফর ইকবাল পুলিশি পাহারায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন, সেখানে অন্য শিক্ষকেরা নিজেদের আরও অনিরাপদ ভাবতে পারেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গিগোষ্ঠীর ‘টার্গেট’ ছিলেন। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার ঘটনা প্রমাণ করছে যে জাফর ইকবালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেসব পুলিশ সদস্য দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন না। তা না হলে ঘাতক কীভাবে জাফর ইকবালের পেছনে দাঁড়ান ও তাঁকে আক্রমণের সুযোগ পান! এই নিরাপত্তাব্যবস্থার অর্থ কী?

এটা স্বস্তির বিষয় যে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বর্তমানে শঙ্কামুক্ত। কিন্তু ঘাতকেরা যে তাদের ‘টার্গেট’ কিলিংয়ের মিশন থেকে সরে আসেনি এ ঘটনা তারই প্রমাণ। মাঝে এ ধরনের হত্যার ঘটনা কমলেও জাফর ইকবালের ঘটনা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আবার নতুন করে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিরাপদ করে তোলার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাস প্রশাসকেরা কীভাবে এটি মোকাবিলা করবেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। ঘাতকেরা যখন তাদের কিলিং মিশন পরিচালনার জন্য ক্যাম্পাসকে বেছে নিচ্ছে তখন আমরা কেউই যে তাদের কাছ থেকে নিরাপদ নই এই বিষয়টি আমাদের সবাইকেই বিবেচনায় নিতে হবে।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
zobaidanasreen@gmail. com