চীনের করোনাভাইরাস: গোদের ওপর বিষফোড়া
নতুন চেহারায় করোনাভাইরাস আগমন নিয়ে এখন আর কোনো বিতর্ক নেই। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়েছে। আমাদের হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চীন থেকে আসা সরাসরি ফ্লাইটগুলোর যাত্রীদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলে জানিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। আমাদের আগে ভারত এটা চালু করে। চীন থেকে আসা সব বিমানযাত্রীর জন্য থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের বন্দোবস্ত করেছে মুম্বাই বিমানবন্দর। অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন চত্বরে পৌঁছানোর আগেই থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হচ্ছে। কারও মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা গেলে সেই যাত্রীকে আইসোলেশন হাসপাতালে পাঠানো হবে। ভারত থেকে যাঁরা চীনে যাবেন, তাঁদের জন্য বিশেষ সফর নির্দেশিকাও জারি করেছে সে দেশের সরকার। হাত ধোয়া, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হলে, সে সংক্রান্ত আচরণবিধি মেনে চলা ও সর্বোপরি কাউকে দেখে অসুস্থ বলে মনে হলে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। রান্না না করা মাংস খেতে ও খামারে যেতে নিষেধ করা হয়েছে ভারতীয়দের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নড়েচড়ে বসেছে। সংস্থার মহাপরিচালক ইথিওপিয়ার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. টেডোরস জরুরি সভা ডেকেছেন। জানুয়ারির ২২ তারিখে সেই সভা বসার কথা। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্সের সংক্রমণে ২০০২-০৩ সালে পৃথিবীর নানা দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৮০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার পেছনেও ছিল করোনাভাইরাস। বিশেষজ্ঞরা এখন নিশ্চিত, নতুন আতঙ্কের কথিত চীনা ভাইরাসটি সাবেক করোনাভাইরাসেরই নতুন সংস্করণ, একই বংশের সন্তান। তবে চিকিৎসকেরা এখনো অভয় দিচ্ছেন ‘চিন্তার কিছু নেই, এখনই নয়া ভাইরাসটিকে সার্সের মতো বিপজ্জনক ভাবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।’
তাহলে এত আশঙ্কা কেন?
চিকিৎসকেরা যতই অভয় দিক না কেন, আসলে নতুন স্টেনে আগত এবারের করোনাভাইরাসের গঠনগত বৈশিষ্ট্য, অভিযোজনের ক্ষমতা বা সংক্রমণের মাধ্যম, কিছুই এখন পর্যন্ত সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়নি। ফলে সেটিকে প্রতিহত করা যাবে, সে ব্যাপারেও সবাই প্রায় অন্ধকারে। শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাথমিক ধারণা, এর সঙ্গে সামুদ্রিক খাবারের বাজারের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। তাই আগাম সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। ‘নিউমোনিয়া’র আলামত নিয়ে আবির্ভূত করোনাভাইরাসের এই নতুন সংস্করণ নিয়ে চীন পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। কথিত রোগে সে দেশে গত দুই
দিনে নতুন করে আরও ১৩৯ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। চীনের বাইরে থাইল্যান্ড ও জাপানে আগেই তিনজনের সংক্রমণের খবর মিলেছিল। সব মিলিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সর্বত্র।
আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার আরও কিছু বিশেষ কারণ আছে। নতুন ভাইরাসের উৎস চীনের উহান শহর। এই শহরে বাংলাদেশের বহু শিক্ষার্থী থাকেন। চীনে শুরু হয়েছে চীনা নববর্ষের ছুটি। স্বাভাবিকভাবে এই সময় দেশে ফিরবেন/ফিরছেন অনেক শিক্ষার্থী। যদি তাঁদের কেউ ওই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে দেশে আসেন এবং তাঁর থেকে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হতে পারে। পাশের দেশ ভারত ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে। সে দেশেরও প্রচুর ছাত্রছাত্রী উহান শহরে পড়াশোনা করেন। ভারত ঘুরেও বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাস আসতে পারে।
তা ছাড়া, বাংলাদেশ থেকে যাঁরা নানা কাজে চীনে যান, তাঁদের একটা বড় অংশ যায় শেনঝানে ও সাংহাইয়ে। এই দুটো এলাকাতেও করোনাভাইরাস হামলে পড়েছে। গত শুক্রবার মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন শেনঝানের একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভারতীয় শিক্ষক প্রীতি মাহেশ্বরী। আইসিইউতে চিকিৎসা চলছে প্রীতি মাহেশ্বরীর। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেটর ও অন্যান্য লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে নানা সরকারি–বেসরকারি প্রকল্পে কর্মরত প্রায় ১৫ হাজার চীনা কর্মীর একটা বড় অংশ চীনা নববর্ষের ছুটিতে দেশে ফিরবেন। ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসবেন বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে। আমাদের না ভাবলে চলবে?
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com