Thank you for trying Sticky AMP!!

চুপ! প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি!

.

অধঃপতনের শেষতম খাদটায় গিয়ে পৌঁছেছি, আমরা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়েছি। আরও অনেকের মতো পরীক্ষার আগের রাতে আমার ফেসবুকের দেয়ালে অনেকেই প্রশ্নপত্র সেঁটে দেন, ই-মেইলে প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয়েছে তার নমুনা আসে, সেসব ই-মেইল আরও আরও সাংবাদিকের কাছেও যায়, যেমন যায় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে। তিনি আগের রাতে পাওয়া প্রশ্নপত্র আর পরের দিনের সত্যিকারের প্রশ্নপত্রের ছবি পাশাপাশি প্রকাশ করে দেখিয়েছেন, প্রশ্নপত্র আসলেই ফাঁস হয়েছে কি না। আমি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খবর দেখলাম, বাচ্চারা বলছে, পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে, কারণ আগের রাত ১০টায় আমাদের কোচিং সেন্টারের স্যার এসে আমাদের কতগুলো ্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দিয়েছেন, আজকে সেসব প্রশ্নই পরীক্ষায় এসে গেছে। এর পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষÿ বলছে, না, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। 
এটাকে বলে ডিনায়াল সিনড্রোম। অস্বীকার করা। এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে যখন জিগ্যেস করা হয়, এই, তুমি নাকি নেশা করছ? সে সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করবে। তারপর যেদিন তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলবেন, এই তো তুমি নেশার জিনিস নিচ্ছ; তখন সে বলবে, এটা সেই জিনিস না। ওই রকম দেখতে বটে, তবে এটা কোনো নেশাদ্রব্য নয়। তারপর যখন আপনি তার রক্ত-প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখবেন যে সে সত্যিই মাদক নিচ্ছে, তখন সে বলবে, এটা আমি একটু শখ করে নিয়েছি, এই এক দিনই, এর আগেও কখনো নিইনি, পরেও নেব না, আমার নেশা হয়নি, আমি এটা এখনই ছেড়ে দিতে পারব।
মাদকাসক্তির চিকিৎসা যাঁরা করেন, সেই বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাদকাসক্তির একটা লক্ষণ হলো, রোগী তা অস্বীকার করবে। খুব সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলবে। খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা কথা বলবে। তারপর আপনি যখন তাকে বলবেন, এই তো প্রমাণ, সে রেগে যাবে।
আমাদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে মন্ত্রী, কর্মকর্তারা একদম মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মতো আচরণ করছেন। তাঁরা ডিনায়াল সিনড্রোমে ভুগছেন। তাঁরা খুব সুন্দর বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। এটা কতিপয় দুষ্টুলোকের মিথ্যা অপপ্রচার। তারপর যখন তাঁদের হাতে প্রমাণ তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা রেগে যাচ্ছেন। বলছেন, তোমার হাতে নকল প্রশ্ন, তার মানে তুমিই অপরাধী।
চিকিৎসকেরা বলেন, মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির প্রথম উপায় হলো স্বীকার করে নেওয়া যে আমি মাদক নিয়ে থাকি, আমি নেশা করি। এটা যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ এই চিকিৎসা খুবই কঠিন। এর পরের ধাপ হলো, রোগীকে চাইতে হবে যে সুস্থ হবে, সে নেশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
এই প্রশ্নপত্র ফাঁস নামের মহামারি রোগের চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো, সরকারকে স্বীকার করতে হবে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। তারপর তাকে চাইতে হবে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস তারা বন্ধ করতে চায়।
বাঙালি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের এই কথার ওপরে আর কোনো কথা নেই, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ বাঙালি যে মানুষ নয়, তার সর্বশেষ ও সবচেয়ে জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো সে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। কোচিং সেন্টারের কর্তাদের ঘুম নেই, তাঁরা রাত ১০টায় পাওয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে ছুটছেন তাঁদের ছাত্রদের কাছে, তাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলছেন, গাধা, এই হলো প্রশ্ন আর এই হলো উত্তর।
যে লাখ লাখ বাচ্চা পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের আর তাদের মা-বাবার দুর্দশা দেখে আমার চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে। বাবা বসে আছেন ফেসবুকে, দেখতে পাচ্ছেন প্রশ্নপত্রের নমুনা বেরিয়ে গেছে, এখন তিনি কী করবেন? তাঁর ছেলেমেয়েকে ডেকে তুলে সেসব প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দেবেন? জীবনের শুরুতেই চুরিবিদ্যার জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য অসুস্থ বানাবেন শিশুটিকে। আবার ছেলেমেয়ের বন্ধুরা পরীক্ষায় ভালো করবে আর তাঁর ছেলেমেয়ে খারাপ করবে, তখন তো বাচ্চাটার মন ভেঙে যাবে। আমি ভয়ে আমার ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব যাদের ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের জিগ্যেস করছি না যে তোমরা কী করছ। এর চেয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন তার জন্য আর কী হতে পারে?
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে অনেকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই দেশে সবকিছু চলছে জুয়োচুরি দিয়ে। সব পেশাতেই ভালো মানুষ আছেন, অনেকেই আছেন, সেটা স্বীকার করে নিই, তা না হলে এত দুর্নীতি, এত অন্যায়, এত পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত এই দেশে সূর্য আলো দিত না, মেঘ বৃষ্টি দিত না। তবু আমার মনে হয়, এই হতভাগা দেশে শিক্ষক শিক্ষকের চাকরি পান লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে, পুলিশ পোস্টিং পায় লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে, শিশুকে স্কুলে ভর্তি করাতে হয় লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে। এই দেশে প্রকৌশলীরা ট্রুথ কমিশনে স্বীকার করেছেন যে কোটি কোটি টাকা তাঁরা আয় করেছেন অবৈধ পথে, এই দেশে চিকিৎসকেরাও সুযোগ পেলে দুর্নীতি করেন। তো এই পোড়ার দেশে হাজার হাজার পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র যাবে, আর তা কেউ খুলে দেখবেন না, তাঁর ছেলেমেয়েকে দেবেন না, সে তার বন্ধুকে দেবে না আর তা ছড়িয়ে পড়বে না, এটা হতেই পারে না। যিনি প্রশ্নপত্র রচনা করেন, সেখান থেকে শুরু করে ছাপাখানা, বিলি-বণ্টন, খামে পোরা, বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো, হলের গেট পর্যন্ত পৌঁছানো—এত সব আয়োজনের সর্বত্র এটা ফাঁস হওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছে।
কাজেই আমার পরামর্শ হলো:
১. প্রাথমিক ও জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষা তুলে দিন। ছেলেমেয়েরা আনন্দের জন্য পড়ুক, ফলের জন্য নয়। জ্ঞানের জন্য পড়ুক, সার্টিফিকেটের জন্য নয়। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবে? আমি জানি, এই পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তনের একটা কারণ ছিল, যাতে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা ঝরে না পড়ে। ঝরে পড়ার এক শ একটা কারণ আছে। এই সার্টিফিকেটের লোভে কেউ ফাইভ পর্যন্ত পড়বে না।
২. মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পাঁচ সেট প্রশ্ন করুন। পরীক্ষার দিন সকালে লটারি করে ঠিক করা হবে কোন সেটে পরীক্ষা হবে। সেটা মোবাইলে/ই-মেইলে/ফোনে সব হলে হলে জানিয়ে দিন।
প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নপত্রেই যাতে লেখা যায়, সেভাবে জায়গা রেখে প্রশ্নপত্র তৈরি করুন।
পাঁচ সেট প্রশ্ন ফাঁস হলে সবগুলো যদি কেউ শিখে আসে, তাহলে সে অন্তত কিছু পড়াশোনা করতে বাধ্য হবে।
আর অভিভাবকদের বলি, পরীক্ষার ফল দিয়ে কী হয়? আসলে তো দরকার জ্ঞান, আসলে তো দরকার উপলব্ধি, আসলে তো দরকার দক্ষতা। আসলে তো দরকার বিবেক।
আপনার ছেলেমেয়েকে ফাঁস করা প্রশ্নের সন্ধান দিয়ে আপনি নিজের বিবেককে ধ্বংস করছেন, আপনার ছেলেমেয়ের বিবেককে ধ্বংস করছেন। আপনি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে থাকলেও জগতের কিচ্ছু এসে যায় না। আপনার অন্তরের ভেতরে আপনি জানেন, আপনি কী।
রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষায় পাস করতেন না, আইনস্টাইন কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভালো ছাত্র বলে সুনাম অর্জন করেননি, টেন্ডুলকার বা সাকিব ক্লাসের ফার্স্টবয় নন—পরীক্ষার রেজাল্টের পেছনে ছোটা বন্ধ করুন, যদি আপনার সন্তানকে জীবনে সফল ও সুখী দেখতে চান।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।