Thank you for trying Sticky AMP!!

চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা

.

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমি যখন ডাক বিভাগের উত্তরাঞ্চল, রাজশাহীর পোস্টমাস্টার জেনারেল পদে কর্মরত, তখন আমার কোনো কোনো বন্ধু বলতেন, ‘এ দেশে জেনারেলদের সংখ্যা খুব কম, তুমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।’ বলা বাহুল্য, তাঁরা ‘জেনারেল’ বলতে আর্মির জেনারেলই বোঝাতেন। প্রত্যুত্তরে তাঁদের আমি বলতাম, হ্যাঁ, আমি এমবিবিএস, তবে ব্র্যাকেটে হোমিও। বিদগ্ধ পাঠকদের আশা করি কথাটার অন্তর্নিহিত কৌতুকরস বুঝিয়ে বলতে হবে না; এবং বুঝিয়ে বলতে হলে কৌতুকের আর রসই থাকে না।
তো রাজশাহীতে আমার টু-আইসি তথা সেকেন্ড–ইন–কমান্ড ছিলেন একজন অতিরিক্ত পিএমজি, যিনি আমার মতো বৃহত্তর সিলেটের অধিবাসী; বাড়ি সুনামগঞ্জে। তিনি একদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন যে তাঁদের সুনামগঞ্জের দিরাই অঞ্চলে পাশাপাশি দুটি গ্রাম আছে; গ্রাম দুটির সব লোকই চোর, ওরা চুরি না করে থাকতে পারে না। আমি প্রথমে কথাটায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে এ ব্যাপারে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন বেরোলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ব্যাপারটা অনেকটা সেই গল্পের মতো আরকি:
এক মজলিসে একবার একজন একটি গল্প বলেছিলেন: এক লোক তাঁর কোঁচড়ে করে ১০টি ডিম নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় এক পূর্বপরিচিত বোকার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটলে সে নেহাত মজা করার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুমি যদি বলতে পারো আমার কোঁচড়ে কী আছে, তাহলে তোমাকে তা থেকে একটা ডিম দিয়ে দেব। আর যদি বলতে পারো কয়টা আছে, তাহলে ১০টার ১০টাই দিয়ে দেব।’ বোকা লোকটি তখন বলল, ‘ভাই, আমি তো গণক নই; আমাকে একটুখানি ক্লু দাও।’ সে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘বাইরে সাদা আর ভেতরে হলুদ রঙের জিনিস।’ ‘ও বুঝেছি’ বোকাটি এবার বলল, ‘তুমি কিছু মুলা নিয়ে যাচ্ছ আর ভেতরে কয়েকটা গাজর আছে।’ তো এই গল্পটি শোনার পর সবাই একচোট হেসে নিলেন। কিন্তু হাসি স্তিমিত হলে ওই মজলিসেরই একজন গম্ভীর গলায় বলে বসলেন, ‘আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, লোকটির কোঁচড়ে কী ছিল?’ তখন সবাই আবার নতুন করে হাসলেন এবং যাঁরা প্রথমে গল্পটি সত্যি হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, তাঁরাও এটা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন।
উপরন্তু আমার ওই সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, গ্রাম দুটির সবাই চুরি করে বিধায় অন্যান্য গ্রামের লোকেরা ওগুলোকে ‘চোরের গ্রাম’ বলে অভিহিত করে থাকে। এবং আমরা যেভাবে এবং যে হারে সম্প্রতি বিদেশি মেহমানদের দেওয়া সম্মানসূচক পদক থেকে সোনা চুরি করেছি, তাতে আমার ভয় হয়, বিদেশিরা না আমাদের ‘চোরের দেশ’ বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে দেন আর বাংলা ভাষায় এযাবৎ বড় ধরনের চুরি বোঝাতে ‘পুকুরচুরি’ কথাটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে, ভবিষ্যতে না ওটার জায়গায় বলা শুরু হয় ‘পদকের সোনা চুরি’। এমনিতেও চুরি সম্পর্কে বাংলা ভাষায় অনেক সুন্দর সুন্দর প্রবচন প্রত্যক্ষ করা যায়। এই যেমন চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা, ঠেকলে বিদ্যা দমাদম; চোরের মন পুলিশ পুলিশ; দশ দিন চোরের আর এক দিন সাধুর; চুরি তো চুরি, তার ওপর সিনাজুরি; কিংবা চোরের মায়ের বড় গলা, খালি মাংগে দুধ আর কলা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সময়ের প্রয়োজন।
সে যা হোক। এবার তাহলে নিশিকুটুম্ব তথা চোরদের সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত কিছু খোশগল্প নিবেদন করা যাক:
এক রাতে এক গরিব লোকের বাড়িতে একাধিক চোর একসঙ্গে প্রবেশ করল। তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেও নেওয়ার মতো কিছু না পেয়ে নিরাশ হয়ে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন জাগ্রত গৃহস্বামী তাদের উদ্দেশ করে বাক্যবাণ ছুড়ল, ‘তোমরা কী আহাম্মকের দল! আমি দিনের বেলায় এই বাড়িতে যেসব জিনিস খুঁজে পাই না, সেগুলো তোমরা রাতের বেলা খুঁজতে এসেছ।’ আরেকবার আরেক চোর মধ্যরাতে ওই লোকের বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই তার জোব্বাটি মেঝেতে বিছিয়ে রেখে জিনিস খুঁজতে গেল, যাতে জোব্বায় বেঁধে নিয়ে যেতে পারে। ঘরে কিছুই ছিল না, সামান্য আটা পেয়ে ওটা নিয়ে এসে জোব্বায় ঢালতে গিয়ে সে দেখে যে জোব্বা নেই, কেননা ততক্ষণে গৃহস্বামী জেগে উঠে চুপিসারে ওটা সরিয়ে নিয়েছে। প্রস্থানোদ্যত চোরকে ধরার জন্য গৃহস্বামী ‘চোর, চোর’ বলে চিৎকার করতেই চোর বলে উঠল, ‘আমি চোর না তুমি চোর, সেটা নিরূপণের ভার তোমার বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলাম।’
আরেকবার এক চোর একজন ধনী লোকের ফলের বাগানে প্রবেশ করে কোঁচড়ভর্তি ফল চুরি করে পালিয়ে যেতে উদ্যত হতেই বাগানের মালিক এসে উপস্থিত। অতঃপর তাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল, তা এ রকম।
: তুমি এখানে অনাহূত কীভাবে এলে?
: আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। একটা ঘূর্ণিঝড় আমাকে এখানে বয়ে নিয়ে এসেছে।
: ওহ্, বুঝলাম ঘূর্ণিঝড় তোমাকে এখানে বয়ে নিয়ে এসেছে এবং গাছের ফলগুলোও ঝড়ের কারণে ঝরে পড়েছে। কিন্তু এগুলো তোমার কোঁচড়ে এল কী করে?
: জনাব, আমি আপনার আত্মার কসম করে বলছি যে আমার কাছেও এটা একটা ধাঁধার মতো ঠেকছে।
তবে আমার বিবেচনায় এ-সংক্রান্ত সবচেয়ে মজার গল্প হচ্ছে এর পরেরটি: এক রাতে একটি চোর একজন বিত্তশালী লোকের বাড়িতে প্রবেশ করে অনেক দামি জিনিস হাতিয়ে রওনা দেবে, এমন সময় তার নজরে এল দুজন নৈশপ্রহরী তার দিকে আসছে। সে তৎক্ষণাৎ একটি ঝাড়ু নিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিতে শুরু করে দিল এবং নৈশপ্রহরীদের প্রশ্নের উত্তরে জানাল যে বাড়ির মালিক সন্ধ্যারাতে পটল তুলেছে; রাস্তা নোংরা ও পরদিন ভোরে অনেক কাজ; তাই সে রাতে রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে কাজ এগিয়ে রাখছে। মৃত ব্যক্তির বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, ‘আগামীকাল ভোরে আপনারা কান্নার আওয়াজ শুনবেন।’ অতঃপর দুই নৈশপ্রহরী তাদের পথে ও চোর বমাল তার পথে চলে গেল।
পরদিন ভোরে সেই বাড়িতে কান্নার আওয়াজ উঠেছিল ঠিকই, তবে বাড়ির মালিকের মৃত্যুর জন্য নয়, মূল্যবান সামগ্রী খোয়া যাওয়ার জন্য।
পাদটীকা: প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টা নগরে নাকি কেউ চুরি করে ধরা পড়লে চুরির জন্য নয়, বরং ধরা পড়ার বোকামির জন্য তার শাস্তি হতো। আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থার প্রচলন করা যেতে পারে।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷