Thank you for trying Sticky AMP!!

জাতির প্রয়োজনেই ট্রাম্পের এই 'পরাজয়'

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন

সব জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের বৈঠক হলো। বৈঠকের পর অধিকাংশ বিশ্লেষকই বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোকা বানিয়ে কিম জং-উন বেশি সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন বা প্রথম বৈঠকে তিনিই জিতেছেন। বৈঠকে উভয় পক্ষ যে অঙ্গীকার করেছে, তাতে আপাতদৃষ্টিতে সে রকমই মনে হতে পারে। কিন্তু এই শীর্ষ বৈঠকের তাৎপর্য নিছক এই জয়-পরাজয়ের মধ্যে নিহিত নয়, এর তাৎপর্য অনেক বড়। 

প্রথমত, বলা দরকার, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার একটি পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। আমরা সবাই জানি, বিশ্বায়নবিরোধী স্লোগান দিয়েই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বিশ্বায়নের নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই ভার আর বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের পরিণতি তার জন্য দুর্বহ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান দুটিই কমছে। এ রকম একটি অবস্থায় বিশ্বায়নবিরোধী স্লোগান দিয়ে ট্রাম্পের মতো খাপছাড়া মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন। অনেকেই মনে করেছিলেন, এসব বাগাড়ম্বর, নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প এসব কিছু করবেন না। কিন্তু এ রকম সব আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে ট্রাম্প নিজের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলেন। এরপর তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন। শুধু তা-ই নয়, কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো মিত্রদের পণ্যেও শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন। সদ্যসমাপ্ত জি৭ সম্মেলনেও এ নিয়ে মিত্রদের সঙ্গে তাঁর চরম বচসা হলো। কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোকে তো তিনি ‘দুর্বল’ আখ্যা দিলেন। ট্রাম্পের মতে, এই মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বেশি সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করা পণ্যে গড়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যেখানে কানাডা করে গড়ে ৩ দশমিক ১ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন করে ৩ শতাংশ। তাই ট্রাম্পের তর্জন-গর্জন একদম অযৌক্তিক নয়।
কিন্তু সেই গরম ট্রাম্পই দিন দু–একের ব্যবধানে সিঙ্গাপুরে কিমের সঙ্গে বৈঠক করতে এসে একদম নরম হয়ে গেলেন। এতে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির বারতা ছড়িয়ে পড়েছে তা যেমন ঠিক, তেমনি ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনেরও অংশবিশেষ। ব্যাপারটা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। এ জন্যও তাকে বিপুল সামরিক ব্যয় করতে হয়। এ ছাড়া ইরাক ও আফগানিস্তানে তাকে বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছে। ৭০টি দেশে তার এ রকম ৮০০টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ অর্থনীতি তার জন্য এখন আর ফলদায়ক নয়। তার এখন দেশের ভেতরে বিনিয়োগ দরকার। সে জন্য তারা এই ঘাঁটি বাবদ ব্যয় কমাতে চায়। তবে যুদ্ধ অর্থনীতি থেকে সে পুরোপুরি সরে আসবে, তা নয়। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তার বৈঠককে সেই আলোকেই দেখা দরকার। সে কারণে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের আগে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের সঙ্গে কিমের বৈঠক হলো। এতে তাঁদের মধ্যকার অবিশ্বাস কিছুটা হলেও কমেছে। উত্তর কোরিয়ার নমনীয় হওয়ার পেছনে চীনের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। তারাই মূলত কিম জং-উনকে প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়া ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি করিয়েছে।
আরেকটি দিকে নজর দেওয়া দরকার, সেটা হলো, উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বিশেষত, অবকাঠামো খাতে তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার (তাদের দেশে কিঞ্চিৎ বিদেশি বিনিয়োগ আছে)। কিছুদিন আগে কিম জং-উনও বলেছিলেন, তাঁরা চীনের আদলে অর্থনীতির দরজা খুলে দিতে চান। মার্কিনরাও কিছু আকর্ষণীয় বিনিয়োগের মুলা ঝুলিয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের যুদ্ধবাজ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন গত মাসে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে এবং দেশটির সঙ্গে ‘বাণিজ্য ও সেখানে বিনিয়োগ করতে’ প্রস্তুত। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পত্রিকা ‘ডংআ ইলবোর’ এক খবরে বলা হয়েছে, কিম জং-উনের এক ঊর্ধ্বতন সহযোগী কিম ইয়ং চোল গত সপ্তাহে ট্রাম্পকে বলেছেন, বিপারমাণবিকীকরণের বিনিময়ে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগ চান। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিনিয়োগকারী ও রজার্স হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের চেয়ারম্যান জিম রজার্স এসব কিছুর মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘১৯৮০-এর দশকে চীন যেখানে ছিল, উত্তর কোরিয়া এখন ঠিক সেখানেই আছে। আগামী ২০ বছরে এটিই হবে বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেশ। উত্তর কোরিয়ার সবকিছুই সম্ভাবনাময়।’ প্রসঙ্গত বলা দরকার, উত্তর কোরিয়ায় বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে।
আর এশিয়া এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি—সে কথা ট্রাম্পের অবিদিত নয়। তাই ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের ধ্বজা উড়িয়ে নিজেকে আরও নিঃশেষিত করার চেয়ে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার এক অনাবিষ্কৃত দেশের অর্থনীতিতে ঢোকার সুযোগকেই শ্রেয় মনে করেছে। এতে সবারই শান্তি। তবে এক বৈঠককেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল, তা ভাবার অবকাশ নেই। বৈঠকের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, দুই কোরিয়া ও চীন কী করে, তার দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে।