Thank you for trying Sticky AMP!!

জি কে শামীমের জামিনে বিস্মিত হয়েছেন যাঁরা

জি কে শামীম। প্রথম আলো ফাইল ছবি

জামিন নিয়ে গরম আলোচনা চলছে। পিরোজপুরকাণ্ডের রেশ না কটতেই ‘জামিন’ শব্দটি আবার শিরোনামে। ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত যুবলীগ নেতা জি কে শামীম জামিন পেয়েছেন। একটি পুরোনো বার্তা এর মধ্য দিয়ে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে যে রাষ্ট্র বা সরকারই শক্তিশালী। তারা যা চাইবে, তা-ই হবে।

তবে স্কুলশিক্ষকের পুত্র থেকে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া জি কে শামীম যদিও এখনই বের হচ্ছেন না; তাঁর নামে আরও মামলা আছে। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে একটা সংশয় জাগতেই পারে। দুটি মামলায় জামিন পাওয়ার পরে এক মাস সময় কেটে গেল। এরপর ‘জানাজানি’ হলো। বহু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে। অনেক সময় পুলিশ বলে, তারা আসামি ধরে আদালতে চালান দেয়। তারপর আসামি জামিন পেয়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া অর্থহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু জি কে শামীমের ক্ষেত্রে অনেক মামলা। অস্ত্র ও মাদক মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে অভিযোগ কতটা গুরুতর, সেটাই বিচার্য।

একজন আইনজীবীর সঙ্গে ফোনে কথা হলো। তিনি একটা ধারণা দিলেন যে শামীমের কাছে পাওয়া অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে, বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার। এখন অবৈধ ব্যবহার কতটা নির্দিষ্ট ও মারাত্মক, সেটাই আসল কথা। ওই আইনজীবী জানালেন, সেটা অনির্দিষ্ট। তাই এমন মামলায় জামিন স্বাভাবিক এবং তা নিম্ন আদালত থেকেই তাঁর পাওয়ার কথা। দ্বিতীয়টি হলো মাদক। যদি বিষয়টি তাঁর বাসা বা ডেরা থেকে কয়েক বোতল বিদেশি মদ পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে কিন্তু জামিনের বিরোধিতা করাটা দুর্বল হয়।

আমরা লক্ষ করব, এই দুটি অভিযোগে যত তাড়াতাড়ি অভিযোগপত্র পাওয়া গেছে, তত গরজে কিন্তু বিচার শুরু করা হবে না। হোক না লঘুদণ্ড। যদি তিনি বিদেশি মদ রাখা বা অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনের বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে শাস্তির তো বিধান একটা আছে। অপরাধের দায়ে কারও শাস্তি চাওয়া এবং রাষ্ট্রের তা নিশ্চিত করা স্বাভাবিক। কিন্তু এটা সন্দেহজনক যে রাষ্ট্র এখানে বিস্মৃতিপ্রবণ হওয়া থেকে নিজকে সামলে রাখবে কি না। কারণ, জি কে শামীম দুষ্ট হলেও ‘আমাদের লোক’।

তাই শামীমের মাদক ও অস্ত্র মামলায় তাঁর জামিন লাভ করা নিয়ে অতটা উতলা হওয়ার কিছু নেই; বরং মানি লন্ডারিং এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধ কবে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে এবং তাঁর বিচার শুরু হবে, সেটা জানাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আপাতত বড় খবর হলো অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য। তিনি বলেছেন, তাঁরা জানতেন না। কিন্তু জামিনদানের আদেশ সত্য হলে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের চোখ কপালে তোলার কারণ নেই। কারণ, হাইকোর্টে যখন জামিনের দরখাস্ত করা হয়, তখন তার কপি বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে জমা দিতে হয়। ২০০৮ সালের আগে ওই কপি দেওয়ার বিষয়টি একটি শিথিল ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন প্রতিটি জামিন আবেদনের ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে কপি দিতেই হয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের ভবনের নিচতলায় ঢুকলেই আপনি বাঁ পাশে একটি লম্বা ডেস্ক দেখবেন। সেখানে কর্তব্যরতরা দ্রুততার সঙ্গে কপি রাখেন। ঝটপট সিল-ছাপ্পর মেরে প্রাপ্তিস্বীকার করেন। সেই সিলমারা কপি দেখেই তবে বেঞ্চ অফিসাররা আবেদন রাখেন এবং জামিনের আদেশ দেওয়ার আগে মাননীয় বিচারপতিগণও সেটা পরখ করে নেন। এটাই প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ।

তবে কখন এই সমাজ-সংসারে আমরা দায়িত্বশীলদের মুখে ‘জানতাম না’ শুনি, সেটা এখন আমজনতাও জানে। কেউ জামিন পাচ্ছেন, কেউ জামিন পাচ্ছেন না। আইন একটিই। আদালতের রীতিনীতি একই। কিন্তু ব্যক্তিভেদে তার প্রয়োগ বদলে যাচ্ছে। আবদুল আউয়াল বা জি কে শামীম—এ রকম নাম অতীতেও সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সামনেও আসবে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর একটা কাজ করতে পারে। চাইলেই তারা এসএমএসের মতো স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ট সার্ভিস চালু করতে পারে। তাহলে আর জামিনের আদেশ নিয়ে ‘জানি’ কিংবা ‘জানি না’-র মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না।

অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্রুত বিচার কাম্য। গুরুতর পরিস্থিতি ছাড়া আইন কারও জামিনদানকে নিরুৎসাহিত করে না। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমসহ গোটা সমাজের সংবেদনশীলতা এখন জামিনকে ঘিরে। গত কয়েক বছরে এটা নানা মাত্রায় বেড়েছে। আবদুল আউয়ালের বিচারটা জরুরি। জানা দরকার তাঁর বিরুদ্ধে দুদক সত্যিই যে মামলাটা করেছে, সেটা ষড়যন্ত্রমূলক কি না। দুদক তার বিরুদ্ধে একটা এজাহার দায়ের করেছিল। এ রকম একটি পর্যায়ে তাঁর জামিন লাভ ছিল আইনগত অধিকার। তাঁর এমনকি আগাম জামিন নিতে আসার কথা নয়। তার মনে, এমন শঙ্কা ভর করার কারণ ছিল না যে এজাহার পর্যায়ে তাঁর জামিন হবে না। কিন্তু পুরো ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে তাঁর আশঙ্কার ভিত্তি ছিল।

সম্রাট, শামীম, পাপিয়া, আউয়াল—এ রকম যাঁরাই আছেন, রাষ্ট্র কি তাঁদের বিচার করতে পারে? মনে হয় পারে না। রাষ্ট্র নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যার বিচার করতে পারে না। রাষ্ট্র ‘ক্ষতিপূরণ’ (জনগণের সর্বনাশ করে) হিসেবে লোকমানের স্ত্রীকে সাংসদ ও তাঁর ভাইকে মেয়র বানিয়ে দিতে পারে। এটা যেন একটা কারখানা। জি কে শামীম, সম্রাট ও পাপিয়ারা সেই একই কারখানার কখনো মালিক, কখনো পরিচালক, কখনো কর্মচারী, কখনো এর বলিও হন।

জামিন দেওয়া বা না দেওয়া যেভাবে চাঞ্চল্য তৈরি করে, সেভাবে বিচার না হওয়ার বিষয় কিন্তু চাঞ্চল্য তৈরি করে না। রাষ্ট্র এভাবে জয়ী হতে চায়। তারা গ্রেপ্তার, জামিন নামঞ্জুর ও রিমান্ড দিয়ে বিচার করতে না পারার অসামর্থ্যকে আড়াল করতে চায়। যার জামিন মঞ্জুর হয়, রিমান্ড হয় না, তার বিচার লাগে না। শুধু মামলাটি ঝুলতে থাকবে। এতে অনেক ফায়দা। রাষ্ট্র চাইলে প্রচলিত আইনের অধীনে যেকোনো মামলা তার রায়সুদ্ধ ‘নেই’ করে দিতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা তা করছে।