Thank you for trying Sticky AMP!!

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের চিন্তাধারা কেন 'বিপজ্জনক'?

কারও কাছে তিনি অহিংস চে গুয়েভারা কারও কাছে তিনি বিপজ্জনক নৈরাজ্যবাদী। কিন্তু তাঁর একটা দর্শন আছে।

অ্যাসাঞ্জ এ মুহূর্তে বিশ্বের প্রধান খবর না হলেও প্রতিদিনকার গুরুত্বপূর্ণ খবর। দীর্ঘদিনের জন্য এই অবস্থা তৈরি হলো।

আসন্ন দিনগুলোয় অ্যাসাঞ্জের খবর মোকাবিলা করতে হলে পাঠকদের বিশেষভাবে জানা দরকার, কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ? ঠিক কী ধরনের চিন্তাধারার জন্য তাঁর মুক্তি আন্দোলন বিশ্ব মনোযোগ দাবি করছে। কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার এককালের কিশোর হ্যাকার আজকে সাংবাদিকতার জগতে মুক্তিদায়ী রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতীক হয়ে উঠলেন। কেন সিআইএর এককালের পরিচালক মাইক পম্পেও তাঁকে ‘আমেরিকার শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এসব জানাবোঝা ছাড়া অ্যাসাঞ্জের খবরাখবরের অগ্রপশ্চাৎ বুঝতে পারব না আমরা।

অ্যাসাঞ্জের ভাবাদর্শই তাঁকে নিয়ে ভীতির কারণ
১১ এপ্রিল গ্রেপ্তারের পর থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যজুড়ে এ মুহূর্তে অ্যাসাঞ্জকে খ্যাপাটে এক বিশৃঙ্খল চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা জারি আছে। তাঁর কাজকর্মের পেছনে যে স্পষ্ট একটা রাজনৈতিক দর্শন কাজ করছে, সেটা লেখনী ও আলাপ-আলোচনাতে সামান্যই পাওয়া যাবে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কেন অস্বাভাবিক নয়, সেটা আমরা বুঝতে পারব তাঁর চিন্তাধারা বুঝতে গেলে।

২০১০ সালের নভেম্বরে খ্যাতনামা ফোর্বস ম্যাগাজিনকে এক সাক্ষাৎকারে অ্যাসাঞ্জ নিজে দার্শনিক হিসেবে শনাক্ত হতে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু স্পষ্টত অ্যাসাঞ্জের কাজের পেছনে রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে। সেটা বোঝার সংক্ষিপ্ত ও সহজ উপায় উইকিলিকসের ‘মেনিফেস্টো’টি পড়ে ফেলা। কেন তাঁর প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস বিশ্বজুড়ে দৈত্যদের মুখোশ উন্মোচনে নেমেছে, তার পেছনকার নৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান না জানলে অ্যাসাঞ্জকে মনে হতে পারে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতায় নামা গোঁয়ার এক ‘মৌলবাদী’ মাত্র।

অ্যাসাঞ্জ আবার শুধু একজন সাংবাদিকও নন; বিশ্বজুড়ে গোপন তথ্য ফাঁসকারী সাংবাদিক কম নেই। তাঁদের বদলে অ্যাসাঞ্জকে থামাতে শক্তিশালী দেশগুলো কেন এত আগ্রহী, তার গোপন রহস্যও হলো অ্যাসাঞ্জের রাজনীতি এবং তাঁর সহকর্মীদলের আদর্শ, যাদের এখন বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘অহিংস ডিজিটাল সেনাবাহিনী’।

অ্যাসাঞ্জ নিজে ত্রুটিহীন চরিত্র নন। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিরও অভিযোগ আছে; যদিও তা আদালতে প্রমাণিত নয়। অ্যাসাঞ্জ একে মিথ্যা অভিযোগ বলে দাবি করেছেন বরাবর। তবে তাঁর অনেক আচরণ, যাযাবর জীবন এবং অতিরিক্ত গোপনীয়তা অনেক সময় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে অতীতে। বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তিনি পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন সময়ই তাঁর মতাদর্শ পাল্টেছে। তবে কিছু বিশ্বাসে সাধারণভাবে তিনি সব সময়ই অনড়। তিনি মনে করেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিশ্বজুড়ে মুক্ত সমাজ নির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ‘উইকিলিকস’ গড়ে তুলেছিলেন। যে প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে বিভিন্ন রাষ্ট্রের যড়যন্ত্রমূলক কাজকর্মকে জনসমক্ষে প্রকাশ করছে, তাদের জবাবদিহি বাড়াতে। উইকিলিকস তার মেনিফেস্টোর প্রথম লাইনেই বলছে: ‘আমরা সরকারগুলোর আচরণে পরিবর্তন ঘটাতে চাই এবং সরকারব্যবস্থাকে আরও খোলামেলা করতে চাই।’ এ ক্ষেত্রে উইকিলিকস ও অ্যাসাঞ্জের প্রধান হাতিয়ার হলো সত্যের প্রকাশ। ‘সত্য’ প্রকাশকারী প্রতিটি ‘ফাঁস’ মাত্রই টিম-অ্যাসাঞ্জের কাছে রাজনৈতিক পদক্ষেপ। শাসনপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হলে ‘রাষ্ট্র’ ও করপোরেটদের ‘গোপন’ জগৎকে জনস্বার্থে প্রকাশ্যে আনতে হবে বলে বিশ্বাস করে তারা। এরূপ ‘গোপনীয়তা’কে অ্যাসাঞ্জ বলেন ‘কর্তৃত্ববাদী ষড়যন্ত্র’-এর প্রধান উৎস। তাঁর দৃষ্টিতে এরূপ ‘ষড়যন্ত্র’ই কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাচর্চাকে জনগণের কাছ থেকে আড়াল করে। তারা জনগণকে সত্য জানতে দেয় না। স্বশাসনে বাধা দেয়। কর্তৃত্ববাদীরা এমনি এমনি পাল্টায় না। তাদের গোপনীয়তার ‘প্রক্রিয়া’য় আঘাত হানতে পারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা।

বলা বাহুল্য, অ্যাসাঞ্জের এই ভাবাদর্শ প্রথাগত রাজনীতির মতো নয়। যা ‘ডান’-এর বিরুদ্ধে ‘বাম’, ‘রক্ষণশীল’দের বিরুদ্ধে ‘গণতন্ত্রী’রা গতানুগতিকভাবে করে যাচ্ছে বিশ্বের দেশে দেশে। অনেকে এটাকে বলতে চাইছেন ‘টেকনো-অ্যানার্কিজম’। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘মুক্ত ও স্বাধীন এক সমাজের প্রত্যাশা’ হিসেবে।

যারা ‘ভেড়ার পাল’ হতে চায় না
প্রথম জীবনে কিশোর অ্যাসাঞ্জ ছিলেন একজন হ্যাকারমাত্র। অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ‘সিস্টেম’-এ হ্যাকিং করে বড় হচ্ছিলেন। গণিতে জন্মগত দক্ষতা এ কাজে তাঁকে বাড়তি সহায়তা দিয়েছিল। কিছুটা রাজনীতিগ্রস্ত হ্যাকারদের মতো তিনিও তখন এটুকুই ভাবতেন, ‘তথ্যকে মুক্তি দিতে হবে।’ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ১৯ বার এরূপ কাজের জন্য অভিযোগের শিকার হয়েছেন তিনি। প্রতিবারই ‘অঙ্গীকারনামা’য় স্বাক্ষর দিয়ে খালাস পান। পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তা ক্রমে গভীরতর রাজনৈতিক রূপ নেয়। তিনি দুর্নীতি ও জবাবদিহির পক্ষে অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিক আন্দোলনে নামতে শুরু করেন। যার বহুদিন পরের পরিণতি আজকের ‘উইকিলিকস’। যা মূলত একটা বৈশ্বিক ঢিলেঢালা ‘নেটওয়ার্ক’ মাত্র। যেখানে বিশ্বজুড়ে জনস্বার্থে নানা ধরনের তথ্য ও নথি এসে জমা হয়। স্কাইপ আর গোপন চ্যাটরুমনির্ভর এই জগতে কাজ করে যাচ্ছে বহু ‘কমরেড’। ন্যাটো দেশগুলো যাদের অস্তিত্বের খোঁজে সব সময়ই মরিয়া। ইতিমধ্যে উইকিলিকস তাদের প্রধান এক শত্রুতে পরিণত হয়ে গেছে।

টিম উইকিলিকসের দর্শন হলো ‘সত্যের পথে বাধাকে মেনে নেওয়ার অর্থ হলো দাসত্বকে মেনে নেওয়া। সত্যের পথে বাধাগুলো খারাপ শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। অবিচারের উৎসও সেটা। সরকারগুলোকে গোপন ষড়যন্ত্র করায় অসমর্থ করতে তুলতে হবে, যা ক্রমে জনতার বিরুদ্ধে অত্যাচারের ক্ষেত্রে তাদের অসমর্থ করে তুলবে।’ এরূপ দার্শনিক অবস্থানের কারণে অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস একই সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ‘রাষ্ট্রবাদী’ অনেকের সমালোচনার শিকার হচ্ছে। যারা ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’-এর ভক্ত। অ্যাসাঞ্জরা লড়ছেন স্বাধীনতা ও মুক্তির ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে। তাঁদের স্লোগান: ‘সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ন্যূনতম সরকার’। নজরদারি, ক্ষমতা ও গোপনীয়তার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রয়াস। কোনোভাবেই এঁরা কর্তৃত্ববাদী এলিট ও করপোরেটদের ‘ভেড়ার পাল’ হতে চান না। সব ধরনের ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর বিপরীতে তাঁদের অবস্থান। তাঁদের অনেকে সেন্সরশিপেরও বিপক্ষে।

একা অ্যাসাঞ্জের পক্ষে যা সম্ভব নয়
৪৭ বয়সের জীবনে অ্যাসাঞ্জ সব সময়ই ‘সিস্টেম’ ভাঙতে চেয়েছেন। সেটা ছিল মূলত শক্তিধর রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জনস্বার্থবিরোধী গোপন তথ্যের সিস্টেম। এই ভাঙার কাজকে তিনি রাজনৈতিক তৎপরতা হিসেবে দেখেন। টিম উইকিলিকসেও হ্যাকার রয়েছে, কিন্তু হ্যাকিং করে বেড়ানো এর কাজ নয়। দলটি মূলত সাংবাদিকতার পেশাগত নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়েই কাজ করে। সে কারণে কোনো জরুরি তথ্য ফাঁসের সময় ফাঁসকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় নিশ্চিত করা হয়। যদিও এ মুহূর্তে বিরুদ্ধবাদীরা তুমুল প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, উইকিলিকসের ‘ফাঁস’গুলো ওই সব দলিলের প্রেরক ও গ্রহীতার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এভাবেই অ্যাসাঞ্জের বন্দিত্বকে ফৌজদারি অপরাধের অনিবার্য সাজা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো তাঁর গ্রেপ্তার একটা রাজনৈতিক ঘটনা মাত্র। একে শুধুই আইনি মোকদ্দমা হিসেবে দেখায় বড় ধরনের সমস্যা আছে। সেটা করা হয় উইকিলিকস ও অ্যাসাঞ্জের কাজের রাজনৈতিক মর্মটুকু আড়াল করতে। তারপরও আশা করছি, অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের মধ্যেই কিছু মানুষ নতুন করে উইকিলিকসের কাজের ভাবাদর্শিক দিকটি সম্পর্কে আগ্রহী হবেন। এ রকম অনুসন্ধানের মধ্যেই বোঝা যাবে, কেবল অ্যাসাঞ্জের মতো একজন ব্যক্তির পক্ষে বিশ্বমোড়লদের কর্তৃত্ববাদী কাঠামোটি ভাঙা সম্ভব নয়। দরকার আসলে অ্যাসাঞ্জের মতো অনেককে।

অ্যাসাঞ্জকে ফৌজদারি অপরাধে বেঁধে ‘ন্যাটো’ এটা দেখাতে চায় যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং জনস্বার্থে গোপন তথ্য ফাঁস একটা অপরাধ। অ্যাসাঞ্জের ক্ষেত্রে তারা সফল হলে বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকতায় যুক্তদের স্বাধীনতা ও পরিসর আরও একধাপ সংকুচিত হয়ে পড়বে।

চলতি অধ্যায়ের বড় বিপদ এখানেই।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক