Thank you for trying Sticky AMP!!

জুলুম ইস্যুতে সবার মুখে কুলুপ

সি চিন পিং

দুই বছরের বেশি সময় ধরে চীন তার ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ওপর নজিরবিহীন নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। দেশটির জিনজিয়াং প্রদেশের প্রতি ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের একজনকে বলা যায় কোনো কারণ ছাড়াই তারা জেলে পুরে রেখেছে। বিশ্বনেতারা এ নিয়ে কেউই তেমন কিছু বলছেন না। তবে তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। তিনি সম্প্রতি টুইটারে চীনকে ‘জুলুম বন্ধ করো’ বলে আহ্বান জানান। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যথারীতি নীরব ভূমিকাই রাখতে দেখা যাচ্ছে।

গণগ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিসি) সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও হাজতখানা ছিল, তার চেয়ে চীনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও হাজতখানা আকারে অনেক বড় এবং প্রযুক্তিসমৃদ্ধ।

চীনে মুসলমানদের আটক করার পেছনে শুধু যে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বন কাজ করছে তা নয়, গোটা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই এই গণগ্রেপ্তার চলছে। নিরপেক্ষ গবেষক ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো মুসলমানদের মদ পান করতে ও শূকরের মাংস খেতে বাধ্য করার বিষয়ে বারবার চীনা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করলেও কর্তৃপক্ষ সেদিকে কান দিচ্ছে না।

উইঘুর মুসলমানেরা নিজেদের জন্মভূমিতে নিষ্পেষিত হচ্ছে। অনেকে পালিয়ে তুরস্কের মতো দূরত্বে যাওয়ার পরও চীনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সেখানে তাদের ধাওয়া করছে। এই মুসলিম জুলুমে যেসব চীনা নেতা ও কোম্পানি জড়িত, তাদের কাউকেই এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়নি।

এই জুলুমের দায় নিঃসন্দেহে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে নিতে হবে। ২০১৪ সালে তিনি এমন কিছু নীতি পরিবর্তনের আদেশ দিয়েছিলেন, যার পরিণতিতে আজ চীনা িভন্ন অন্য জাতিগুলোর মধ্যে উইঘুর, কাজাখ, গিরগিজ, হুই এবং অন্যান্য মুসলিম গ্রুপের সদস্যদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে। মুসলিমদের জোর করে হান সংস্কৃতির মধ্যে আত্তীকরণ করা দৃশ্যত ‘সিইজম’ (সি চিন পিংয়ের মতাদর্শ)-এর প্রতিফলন। এই সিইজম চীনে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে, যা চীনে মার্ক্সবাদ এবং মাওবাদকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।

চীনের মাটি থেকে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে সি চিন পিং (যাঁকে মাও সে তুংয়ের চেয়েও বেশি শক্তিধর নেতা মনে করা হচ্ছে) কুখ্যাত সিপিসি এনফোরসার চেন কুয়াংগুকে তিব্বতিদের দমন করতে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। সেই চেন কুয়াংগুকে তিব্বত থেকে সরিয়ে জিয়ানজিং প্রদেশে আনা হয়েছে মুসলিমদের দমন করার জন্য। চেন কুয়াংগুর নৃশংসতার কথা সর্বজনবিদিত হলেও গুলাগ নীতি (সাবেক সোভিয়েত সরকারের মুসলিম দমন নীতি) অনুসরণ করা কুয়াংগু এবং অন্য নৃশংস চীনা নেতাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো কিছু বলছে না। মূলত আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে চীনের এই মুসলিমবিরোধী নীতির বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের সময় যে মুসলমানপ্রধান দেশগুলো দ্রুততার সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র তুরস্ক ছাড়া বাকি সবাই চীনের মুসলিম নির্যাতনের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে। এদের মধ্যে পাকিস্তানের সেনাসমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, জিনজিয়াংয়ে মুসলমানদের ওপর যে অভিযান চলছে, তার খবর তিনি নাকি জানেনই না। আর সৌদি আরবের মহা ক্ষমতাধর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তো বলেই ফেলেছেন, ‘সন্ত্রাস মোকাবিলা করার অধিকার চীনের রয়েছে।’

আন্তর্জাতিক চাপ না থাকায় বেপরোয়া হয়ে চীন এবার গোটা জিনজিয়াংয়ে বিশুদ্ধ চীনা সংস্কৃতি চালু করতে অভিযান শুরু করেছে। উরুমাকিসহ আশপাশের সব মুসলিম-অধ্যুষিত শহর থেকে ইসলামি সংস্কৃতি মুছে ফেলতে বিপুল পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

কূটাভাস হলো এই, চীন একদিকে তার ভূখণ্ড থেকে ‘ইসলামি উগ্রপন্থীদের’ উৎখাত করার কথা বলছে, অন্যদিকে সে ভিন্ন দেশে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ভারতের পুলওয়ামায় জওয়ানদের গাড়িবহরে হামলা চালানো পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারকে নিষিদ্ধ করতে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উঠলেও চীন তার বিরোধিতা করে আসছে। মাইক পম্পেও টুইট করে বলেছেন, ‘মুসলমানদের প্রতি চীনের লজ্জাজনক ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ বিশ্ব আর মেনে নিতে পারে না। একদিকে তারা নিজের ঘরে লাখ লাখ মুসলিমকে নির্যাতন করছে, অন্যদিকে ভয়ানক সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে আনা নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবে ভেটো দিচ্ছে।’

চীনের এই মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থান ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্ররোচিত করছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলা চালানো অস্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসী তাঁর জবানবন্দিতে চীনের রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি তাঁর সহমর্মিতার কথা বলেছেন।

সি চিন পিংয়ের নজরদারি কর্মকাণ্ডের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটাতে চীন গোটা জিনজিয়াংকে কীভাবে একটি ‘গবেষণাগারে’ পরিণত করেছে, তা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হতে পারে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে চীন যে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়ন করছে, সেই স্থলপথ যে যে অঞ্চল দিয়ে যাবে, সেই সেই অঞ্চলকে শতভাগ নজরদারির আওতায় রাখতে চায় চীন। এই রুট যেহেতু জিনজিয়াংয়ের ওপর দিয়ে গেছে, সেহেতু সেখানে তারা মুসলিমদের নখদর্পণে রাখতে চায়।

মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, নাৎসিবাদ, স্টালিনবাদ এবং মাওবাদ যেভাবে লাখ লাখ মানুষের জীবন হরণ করেছে, একইভাবে এখন ‘সিইজম’ বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু মানুষ মেরেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না, সংখ্যালঘুদের কৃষ্টি-কালচারও তারা মেরে ফেলছে।

এই জুলুমের জন্য চীনকে হয়তো কোনো আন্তর্জাতিক সাজার মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু এটি নিশ্চিত, এতে নতুন প্রজন্মের ইসলামি জঙ্গিবাদের মুখে পড়তে পারে দেশটি। এতে তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাজেট ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষা বাজেটকে ছাড়িয়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল এবং শেষমেশ সেই বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙেও পড়েছিল।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক