Thank you for trying Sticky AMP!!

জেনেশুনে বিষ করছি পান

শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরছিলাম। আমার পাশের সিটে দুজন বিদেশিনী বসা ছিলেন। ঢাকার আকাশে প্রবেশ করে বিমানটি যখন নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন তাঁদের একজন আরেকজনকে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘লুক লুক সো মেনি বিল্ডিংস’! নেত্রে বলে উঠলেন, শুনে গর্বে আমার বুক স্ফীত হয়ে গেল। কারণ আমরা যেখানেই দেখিবে ফাঁকা, তুলিবে ভবন পাকা-এই নীতিতে বিশ্বাস করি।

অনেক দিন পর দুই বন্ধুর দেখা। একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন, কিন্তু অপরজন তাঁর হাত লুকিয়ে ফেললেন। প্রথম বন্ধু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হলো বন্ধু, হাত লুকিয়ে ফেললে কেন?’ দ্বিতীয় বন্ধু উত্তর দিলেন, ‘শুনেছি তুমি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ধরেছ, তাই ভরসা পাচ্ছিলাম না, যদি তুমি আমার হাতের তালুটিও খালি পেয়ে চেয়ে বসো!’

এখন চলছে যত্রতত্র, যেমন খুশি ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা। রেহাই পাচ্ছে না নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর, খেতখামার, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত কোনো কিছুই। এ ছাড়া যে আমাদের উপায়ও নেই। বিশাল জনগোষ্ঠীর মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই তো। কিছুদিন আগে প্রথম আলোর পাতায় একটি খবরের শিরোনাম দেখেছিলাম, ‘মানুষের ভারে বিপন্ন রাঙামাটি’। যদি বলা হতো, মানুষের ভারে বিপন্ন দেশ, তাহলে কি ভুল হতো? বোধ হয় না।

‘প্রয়োজন আইন মানে না’ বলে একটি কথা আছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের একটি ক্ষুদ্র দেশে ১৬ কোটি (মতান্তরে ২০ কোটি), যা প্রতিবছর জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০ বছরে তা কত হবে, সেটা ভেবে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। তখন ভবন দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গাটুকুর জন্যও চলবে মারামারি, খুনোখুনি; যার আলামত তো এখনই দেখতে পাচ্ছি। যানজটের চেয়ে কম ভয়াবহ নয় মানবজট এবং তা দেশব্যাপী।

১০ বছর আগেও যেখানে ছিল ফসলভরা মাঠ, সেখানে আজ ঘনবসতি। যেটুকু খালি আছে, তাতেও শোভা পাচ্ছে স্বপ্নের আবাসনের বহু চটকদার বিজ্ঞাপন। অর্থাৎ, অচিরেই সেখানে গড়ে উঠবে সবুজের স্থলে ইট-পাথরের বাগান। জ্যামিতিক হারে ক্রমবর্ধমান আদমসন্তানের মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই তো! তারপর রয়েছে তাদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজন মেটাতে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা। উন্নত বিশ্ব থেকে বিতাড়িত (পরিবেশদূষণ বা সহজলভ্য শ্রমের সুবিধার জন্য) অনেক শিল্পকারখানা লুফে নিচ্ছি আমরা। ধ্বংস হচ্ছে ফসলের জমি, দূষিত হচ্ছে একদা সুপেয় নদীজল। মানবসন্তানের কর্মসংস্থানের জন্য আর বিকল্পই বা কী আছে?

বাংলাদেশের যুবসমাজের প্রায় ১ কোটির কোনো কাজ নেই, নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা। কিন্তু তাঁদেরও তো বেঁচে থাকতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে বিবেক-বুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায়, আইনকানুন বেঁচে থাকার সংগ্রামের কাছে নির্বাসিত। চাঁদাবাজি, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, মারামারি, কাড়াকাড়ি-যেভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু একসময়ের বাঁচার সংগ্রাম কালক্রমে রূপ নিতে পারে বিত্তবৈভবের সংগ্রামে। অনিশ্চয়তা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও সহায়-সম্বল বিক্রি করে কর্মহীন মানুষ জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। তাঁদেরই পাঠানো অর্থে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় হচ্ছে স্ফীত, এতে আমরা গর্বও বোধ করি। কিন্তু এ জন্য যে নির্যাতন, অপমান সহ্য করেও শুধু প্রাণের দায়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে তাঁদের, গোটা জাতির মান-অপমানবোধে কি তা একটুও আঘাত করে না? এরপরও আমাদের বিভিন্ন দেশের কাছে ধরনা দিতে হয়, আবেদন-নিবেদন করি, ‘আমাদের কিছু কাজের লোক নিন।’

প্রতিদিন খবরের কাগজগুলোর যে খবরটি সবাইকে মর্মাহত ও আতঙ্কিত করে, তা হলো নানা ধরনের অপমৃত্যু। সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি, পাহাড়ধস আর নিয়মিত খুনোখুনি তো রয়েছেই। অতিরিক্ত যাত্রী বহন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, প্রশিক্ষণহীন, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক-এ সবই যে সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবির অন্যতম কারণ, তা তো বিশেষজ্ঞরা বলছেনই। বাস, ট্রেন, লঞ্চের ছাদে দুর্ঘটনার ঝুঁকি জেনেও যাত্রীর অভাব নেই। কারণ, যেভাবেই হোক তাঁদের যেতেই হবে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। পাহাড়ধসের অন্যতম প্রধান কারণ পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ। কিন্তু ঝুঁকি নিয়েও যাঁরা সেখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বাস করছেন, তাঁরা কি গ্রীষ্মকালীন শৈলাবাসে অবসরযাপনের জন্য যাচ্ছেন? নাকি প্রাণের দায়ে যাচ্ছেন, মাথা গোঁজার একটু ঠাঁইয়ের আশায়? আর যে কোথাও ঠাঁই নেই।

অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা’। প্রকৃতি আমাদের দুই হাত ভরে যে সম্পদ দিয়েছিল, তা সারা পৃথিবীতেই সেরা। এ দেশের মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। এমন উর্বর মাটি পৃথিবীর আর কোথাও ‘খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। কিন্তু ডি এল রায় এ গানটি রচনা করার সময় কি জানতেন এ দেশের মাটির উর্বরতাকেও ছাড়িয়ে যাবে মানুষের উর্বরতা? আরও ভাবার বিষয় সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের বোঝা। মানবিক কারণে এই বোঝা আমাদের বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু কত দিন তা সম্ভব? পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল যাওবা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তা-ও উজাড় হতে চলেছে। অধিকন্তু, প্রজনন সক্ষমতায় তারা আমাদের চেয়েও এক কাঠি ওপরে।

বিষয়টি নিয়ে ভাবার বোধ হয় সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই গতিতে উদ্বৃত্ত মানবসম্পদ সঞ্চিত হতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী দেশ রেখে যাব আমরা, তা ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়। আমার তো মনে হয়, একটি বিষয়েও যদি জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন থেকে থাকে, তাহলে এই সমস্যাই হবে প্রথম বিবেচ্য। অনেকেই হয়তো বলবেন, এর জন্য তো আমাদের একটি মন্ত্রণালয়ই রয়েছে। সেমিনার, ওয়ার্কশপ, বিদেশ ভ্রমণ রয়েছে; কিন্তু ফলাফল কী?

হ্যাঁ, কিছু যে হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু সমাজের যে অংশে হচ্ছে, সেখানে ব্যক্তি নিজেই সচেতন এবং সন্তান মানুষ করার সামর্থ্যও তাদের রয়েছে। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী তথা সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যাদের কাছে জীবনমান নয়, জীবন রক্ষার সংগ্রামই মুখ্য, তাদের কাছে পৌঁছাতে হলে দপ্তরে বসে সেমিনার আর দু-একটি বিজ্ঞাপন কোনো কাজে আসবে না। ‘মিশন’ মনে করে এদের কাছে পৌঁছাতে হবে। অন্যথায় প্রকৃতির কাছেই এর সমাধান ছেড়ে দিতে হবে, যার কিছু কিছু আলামত প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান। পরিকল্পনার এই যুগে নির্বোধ প্রাণীর মতো নির্বিকার বংশবৃদ্ধি এই সম্ভাবনাকেই ত্বরান্বিত করেছে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী : সংগীতশিল্পী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা