Thank you for trying Sticky AMP!!

জোরেশোরে নামার এখনই সময়

ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিয়েছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে। মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত—প্রায় সাড়ে ছয় মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে লেখাপড়ার কী অবস্থা হবে, তা অনুমান করা যায়।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা এখনই পুরোদমে অনলাইন লেখাপড়ায় নেমে পড়ার পক্ষে। তাঁদের মতে, অনলাইনে এখন সামান্য লেখাপড়া হচ্ছে। এতে যতটা জোর দেওয়ার কথা, ততটা দেওয়া হচ্ছে না।


এমনিতেই বছরের প্রথম মাস চলে যায় প্রস্তুতি নিতে, শেষ মাস পরীক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রমে। এ ছাড়া থাকে নির্দিষ্ট ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি। পাবলিক পরীক্ষার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।


এ বছর প্রায় ২০ লাখ পরীক্ষার্থী ফেব্রুয়ারি মাসে মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষাগুলো দিয়েছে; কিন্তু ফল প্রকাশ করা যাচ্ছে না। প্রায় ১৩ লাখ পরীক্ষার্থীর উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষাগুলোতে বসার কথা ১ এপ্রিল থেকে। কিন্তু পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। কবে সেগুলো অনুষ্ঠিত হবে তা অনিশ্চিত। বছরের শেষে আছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। মাধ্যমিক পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ও উচ্চশিক্ষায় ভর্তি—সবই সময়ের ছকে বাঁধা। এগুলো ওলট–পালট হয়ে যাবে। কিন্তু পরীক্ষা যখনই হোক, লেখাপড়া ও জানাশোনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি অধ্যায়, অনুচ্ছেদ রপ্ত করাই শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি। তা না হলে জ্ঞানের এই শূন্যতা রয়ে যাবে জীবনভর।


গত সোমবার গণভবন থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখন স্কুল–কলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলব না। অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল–কলেজ সবই বন্ধ থাকবে, যদি করোনাভাইরাস অব্যাহত থাকে। যখন এটা থাকবে না, তখনই খুলব।’
তাঁর এ বক্তব্যের পর শুরু হয়েছে লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা। অনেক শিক্ষক বিচ্ছিন্নভাবে অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন। বেসরকারি কিছু স্কুল–কলেজ সীমিত পরিসরে ক্লাস নিচ্ছে অনলাইনে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ছুটি বাড়ার সম্ভাবনা দেখে এই ছাড় দেওয়ার পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। আশা করা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নিয়ে এবং খাতা মূল্যায়ন করে সস্তা সনদ দেওয়ার বদনামে যুক্ত হবে না। দূরশিক্ষণের দুর্নাম ঘুচাতে এবং আউটার ক্যাম্পাসে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রির দায় থেকে মুক্তি পেতে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনেক সময় পার করতে হয়েছে। অনলাইন শিক্ষার সুবাদে সেই পুরোনো পথে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যাতে ফিরে যেতে না পারে, সে জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির দায়িত্ব রয়েছে।


বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ বা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিটিং অ্যাপ জুমের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের বাসায় কাজ দিচ্ছেন। কিন্তু এখন বড় পরিসরে এ উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে।


এ দেশে ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আছেন স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা বা পৌর চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা আছেন অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান (অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক) ছাড়াও এসব জনপ্রতিনিধি বা স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তার বড় ভূমিকা রাখার সময় এসেছে। নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে লেখাপড়া নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।


আগে শিক্ষার্থীর জীবন, পরে লেখাপড়া—এই দৃষ্টিকোণ থেকে যত দিন প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতেই হবে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লেখাপড়া চালু করতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। শিক্ষক তো বেতন পাবেনই, তিনি অনলাইনে ক্লাস নিতে আপত্তি করবেন না। কিন্তু তাঁকে উদ্বুদ্ধ করা, কিছুটা চাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয়তো আছে।


অনলাইনে লেখাপড়ার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। কিন্তু দেশের সব এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধা নেই, কোথাও নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল। দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকায় এটাই প্রথম বাধা।


দ্বিতীয় বাধা হলো স্মার্টফোনের অভাব। বলা হয়ে থাকে, মোট মোবাইল ফোনের ৪০ শতাংশ স্মার্টফোন নয়, বাটন ফোন।


২৫ শতাংশ এলাকা আর ৪০ শতাংশ মোবাইল ফোন বাদ দিলেও বাকি শিক্ষার্থীরা কিন্তু অনলাইনে যুক্ত হতে পারে। সে জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, নির্দেশ ও নজরদারি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের সক্রিয় চেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর আগ্রহ,অভিভাবকের সহায়তা তো অবশ্যই থাকতে হবে।
রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে ইন্টারনেটের গতি এখন খারাপ নয়। ইউনিয়ন পর্যন্ত ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর চেষ্টা বহুদিন ধরে চলছে, কিন্তু অগ্রগতি কম। ডিজিটাল ক্লাসরুম, টিচার্স পোর্টালে কনটেন্ট আপলোড করা, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি ল্যাপটপ—সরকারের এমন অনেক প্রকল্প মার খেয়েছে। তৃণমূলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি আটকে গেছে। হাইস্পিড ইন্টারনেট দূরে থাক, মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য গতিও নিশ্চিত করা যায়নি অনেক এলাকায়। এটা করতে পারলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির ওপর প্রভাব পড়ত। আমরা ফোরজি নেটওয়ার্কে গেলাম। কিন্তু মোবাইল অপারেটররা তাদের অনেক টাওয়ার আপগ্রেড করতে পারেনি। তাদের যুক্তি, সরকার লাইসেন্স ফি নিয়েছে অনেক, এ ছাড়া তাদের আয়ও কমেছে। যদিও সরকার তাদের এই যুক্তি মানতে নারাজ। সরকার দায়ী করে বেসরকারি খাতকে, বেসরকারি খাত দায়ী করে সরকারকে।


এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সরকারি–বেসরকারি কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। প্রায় প্রত্যেকের জন্য এত রকম আইন আছে, এগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রায় অসম্ভব। সমন্বয়ের জন্য আছে ডোমেস্টিক নেটওয়ার্ক কো–অর্ডিনেশন কমিটি। এই কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি সেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু সুফল ততটা দৃশ্যমান নয়, যতটা প্রত্যাশিত ছিল।


নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ। সরকারের সামান্য উদ্যোগ বা সহায়তা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনেক দূর এগিয়ে দেয়। পাবলিক পরীক্ষার নিবন্ধন থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ পর্যন্ত অনেক কিছুই ডিজিটাল পদ্ধতিতে হচ্ছে। প্রাত্যহিক জীবনে এখন তথ্যপ্রযুক্তি অনিবার্য। শিক্ষায় এই ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে, এখনকার পরিস্থিতিতে এটা সময়ের দাবি।


চলমান ছুটির সময় সংসদ টিভির মাধ্যমে স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য রেকর্ডিং ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি কার্যকর হয়েছে, এমনটি বলা যায় না। রুটিন না মেনে ক্লাস নেওয়া, সময়ের হেরফের, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া, শিক্ষকের দক্ষতা—এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরক্তি আছে। এরপরও বিষয়টি মন্দের ভালো হিসেবে চলছে। কেউ ক্লাসে অংশ নিতে না পারলে পুনঃপ্রচার দেখার সুযোগ আছে, এ ছাড়া ফেসবুক বা ইউটিউবেও দেখে নেওয়া যায়। তবে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ক্লাসের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। এর পাশাপাশি অনলাইনে লেখাপড়া যত দূর সম্ভব ছড়িয়ে দিতে হবে।


দেশের শিক্ষা প্রশাসন অনেক বড়। জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের একাধিক শিক্ষা কর্মকর্তা আছেন। অনলাইন শিক্ষার বিকাশে সরকারের পক্ষে নজরদারি বাড়ানোর কাজটি এসব কর্মকর্তাই করতে পারেন। অনলাইনে আংশিক বা বিচ্ছিন্ন লেখাপড়া নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার সময় আর নেই, এটা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এর ওপর বিশেষ জোর দেওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান করতে হবে। অন্তত ইন্টারনেট সুবিধা থাকা দেশের ৭৫ শতাংশ এলাকার সব শিক্ষার্থী যেন অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসে—সেটাই হোক সবার লক্ষ্য।

শরিফুজ্জামান : হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো।
Pintu.dhaka@gmail.com