Thank you for trying Sticky AMP!!

জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ

একুশ শতকে গোটা বিশ্ব জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংকল্পবদ্ধ, আমরাও বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের অত্যন্ত জুতসই স্লোগান নিয়ে বদ্ধপরিকর। দেরিতে হলেও জ্ঞানভিত্তিক নানা প্রতিযোগিতায় আমাদের তরুণ সম্প্রদায় বছর বিশেক ধরে অংশগ্রহণ করছে। এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের ছেলেমেয়েরা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করছে। এবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কঠিন আসরে দেশভিত্তিক র‍্যাঙ্কে আমাদের অবস্থান ২৬ আর ভারতের ৫২। আমরা দুটি করে রুপা ও ব্রোঞ্জপদক জিতেছি। পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াডে একটি রুপা ও তিনটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছি।

ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের তিনজন স্কুলছাত্র তাসমীম রেজা, রুহান হাবিব ও রুবাব রেদওয়ান এবং নটর ডেম কলেজের যুবায়ের রহমানের যাত্রা মরিয়ম মির্জাখানির দেশ ইরানে। ইরান জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় তার অবস্থান সুদৃঢ় করেছে বেশ আগেই। তা ছাড়া এ প্রতিযোগিতার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপও ইরান একাধিকবার আয়োজন করেছে। এবার করছে আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড।

এই প্রতিযোগিতায় ইরান এ বছরের আগ পর্যন্ত ২১টি স্বর্ণপদকসহ ৯০টির বেশি পদক জিতেছে। এবারের আয়োজন আমার দেখা সব ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দলনেতাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে পার্সিয়ান আজাদি হোটেলে, প্রতিযোগীদের জন্য অদূরে অবস্থিত এভিন হোটেল। দুটিই তেহরান শহরের উত্তরে পাহাড় ঘেঁষে দামি জায়গায়। আমাদের দল তেহরান ও শরিফ বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছে, ইরানিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে।

শেখ সাদির দেশ ইরান, ওমর খৈয়ামের দেশ ইরান, হাফিজের দেশ ইরান, জালালুদ্দিন রুমির দেশ ইরান। কম্পিউটার বিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো অ্যালগরিদম—এই নামের সূচনাও কিন্তু পারস্যের গণিতবেত্তা ও জ্যোতির্বিদ আল খারিজমির নাম থেকে এসেছে, যেমন হয়েছে অ্যালজেবরা শব্দের উৎপত্তি আলখারিজমির বই ইলম আল জাবর ওয়াল মুকাবালা থেকে।

আমরা জানি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র কিংবা জীববিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার থাকলেও গণিত কিংবা কম্পিউটার বিজ্ঞানে এই পুরস্কার নেই। কানাডীয় গণিতজ্ঞ জন চার্লস ফিল্ডসের অর্থায়নে ১৯৩৬ সালে গণিতের নোবেল পুরস্কারখ্যাত এই পুরস্কারটির সূচনা। এখন প্রতি চার বছরে দুই, তিন কিংবা চারজন অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী বিজ্ঞানীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই পুরস্কার একজন ইরানি নারী গণিতজ্ঞ পান, যাঁর নাম মরিয়ম মির্জাখানি। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু এতটাই জটিল ছিল যে সে ক্ষেত্রটি পুরুষ গণিতবেত্তারাও এড়িয়ে চলতেন। বিজ্ঞানের প্রতি ইরানিদের যে ভালোবাসা, তা টের পেলাম ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে এসে। তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের ছবিসহ আবিষ্কারের নানা তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে তোরণ, যাতে কোনো বিদেশির দৃষ্টি না এড়ায়। এক মেয়ে স্বেচ্ছাসেবককে জিজ্ঞাসা করলাম মির্জাখানিকে চেনে কি না। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করল, আমরা একই বিভাগের ছাত্রী। শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিকে ইরানের এমআইটি বলা হয়। রাজধানীতে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মির্জাখানি পাস করেছেন।

স্থাপত্যের আইনস্টাইন-খ্যাত এফ আর খান আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক, বাড়ি ফরিদপুর, পড়ালেখা বেশির ভাগই বাংলাদেশের মাটিতে। ১০০ তলা জন হ্যানকক সেন্টার এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ইমারত ১১০ তলা সিয়ার্স টাওয়ারের ডিজাইনার এফ আর খানের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো শহরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মিলনস্থল নামকরণ করা হলেও তাঁর নিজের দেশে কিছু নেই। কী অভাগা আমাদের দেশটি। শ্রেষ্ঠ সন্তানকে অস্বীকার করার এই ধারা থেকে কবে আমরা বের হয়ে আসতে পারব? মির্জাখানি এক বিদেশিকে বিয়ে করেছিলেন, ইরানের রক্ষণশীল সমাজ এটা ভালোভাবে নেয় না, তবু দেশটির সরকার ও মানুষ যেভাবে তাঁকে ভালোবাসায় আলিঙ্গন করেছে, তা সত্যিই বিস্ময়ের। আমাদের চরিত্রের এই উন্নতি কবে হবে। যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী মানুষ জন্মায় না। এমনকি এই অলিম্পিয়াডেও আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা অংশ নেওয়া অসুস্থ অধ্যাপক ঘোদসিকে যে সম্মান জানানো হলো, তাতে অভিভূত হয়ে গেলাম।

যাহোক, এবার ফিরে আসি ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে। ২০০৪ সালে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নেতৃত্বে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রবীণ শিক্ষকদের নিয়ে বাংলাদেশ ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড গঠিত হয়েছিল। আমাদের এই উদ্যোগে নানা সময়ে নানা প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, যার মধ্যে আছে নির্মাণ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, জনতা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি এবং তিন বছর ধরে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদের নেতৃত্বে আইসিটি বিভাগ। বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সব অলিম্পিয়াড থেকে প্রথম যে রৌপপদক আসে তা হলো ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড থেকে আবিরুল ইসলামের হাত ধরে বুলগেরিয়া থেকে। এবার আমাদের প্রত্যাশা বেশি ছিল। আমাদের খুদে প্রোগ্রামাররা কিছুটা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধও ছিল। গত বছর রাশিয়ার কাজান শহরে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তারা দুটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছিল। এ ছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিযোগিতায় এই খুদে কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা সব সময়ই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল হয়নি। তবু সম্ভবত এই প্রথম আমাদের দেশের অলিম্পিয়াড দলের প্রত্যেকেই একটি করে পদক জিতেছে। আমরা চারটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছি আর ভারত পেয়েছে তিনটি। আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড দলও ভারতকে পেছনে ফেলে দুটি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জপদক জিতেছে। ৮৪টি দেশের ৩০৮ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে আয়োজক দেশের আরও চারজন। পাঁচ ঘণ্টার প্রতিযোগিতায় আমাদের তাসমীম রেজা রৌপ্যপদক পাওয়ার মতো অবস্থানেই ছিল। প্রতিযোগিতাকালে আধঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দেওয়াতেই যত বিপত্তি। অন্য দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের স্কোর বাড়াতে পারলেও তাসমীমের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম স্বর্ণ জয় করেছে, ইরান, কোরিয়া ও ব্রাজিল স্বর্ণপদক জিতেছে। আমাদেরও জিততে হবে।

আমাদের দলনেতা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান দলের জন্য সব ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে শেষ মুহূর্তে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য যেতে পারেননি। খুবই আনন্দের বিষয়, আমাদের স্নাতক জিসান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে ইরানের বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করায় কাউন্সিলর মোমেনুল হক স্ত্রীসহ বিমানবন্দরে আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানান। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো এ ধরনের অনুষ্ঠানে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের উন্নততর ভাবমূর্তি তৈরিতে অবদান রাখবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।