Thank you for trying Sticky AMP!!

জয়তু নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়

মুখোশ নাটকে আবুল হায়াত ও নিমা রহমান

‘আসব?’ 

‘নো!’
বেশ গম্ভীর গলায় পরিচালকের উত্তর এল। ঘড়ির দিকে তাকালাম, পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে আমার।
এই আমার যাত্রা শুরু গ্রুপ থিয়েটারে। প্রথম দিনেই পরিচালকের মেজাজের সঙ্গে পরিচিত হলাম। ঝাড়া প্রায় এক ঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। ভেতরে তখন একটি দৃশ্যের মহড়া চলছে। মহড়া শেষে পরিচালক ডাকলেন ভেতরে। তারপর কিছু বক্তৃতা শুনতে হলো তাঁর কাছ থেকে। বক্তৃতার মূল কথাই হচ্ছে নাটক ছেলেখেলা নয়। সকলের যৌথ কর্ম। সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সময়মতো মহড়ায় আসা, লাইন মুখস্থ করা, মহড়ায় অন্যদের কাজ দেখা এবং অন্য আরও অনেক কিছু, যা পরবর্তী সময়ে আমরাও নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি।

ঘটনাটা ১৯৬৮ সালে। বুয়েটের (তখনকার ইপিইউইটি) স্থাপত্য বিভাগের নতুন ভবনে ইদিপাস নাটকের মহড়ার ঘটনা। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রথম নাটক-কিন্তু মঞ্চে নয়, টেলিভিশনের জন্য, সেটারই মহড়া চলছিল। পরিচালনায় ছিলেন নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি ও নাট্যকার জিয়া হায়দার। তবে হ্যাঁ, প্রথমেই বলে রাখি, ওই যে কড়া মেজাজ দেখেছিলাম, ওটা ছিল পরিচালক জিয়া হায়দারের, ব্যক্তি জিয়া হায়দার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব। সহজ, সরল, মৃদুভাষী, নিপাট ভদ্রলোক যাঁকে বলা হয়।

আমি অভিনয় শুরু করেছিলাম ১০ বছর বয়সে, চট্টগ্রামে। পাড়ায় নিজেরা মঞ্চ বানিয়ে। তারপর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা নাটকে করেছি অভিনয়, কিছু পরিচালনাও করেছি কিন্তু অভিনয়-বিজ্ঞান কী কিছুই জানতাম না বা জানার তেমন সুযোগ কোনো দিন হয়নি। তাই প্রথম চমক লাগল সেদিন, যখন শুনলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিয়া হায়দার নামের এক ভদ্রলোক নাটকের ওপর মাস্টার্স করে এসেছেন, তিনি একটি থিয়েটার গ্রুপ করবেন। একটি টিভি নাটক দিয়ে তার গোড়াপত্তন হবে, তাতে আমাদের মতো কিছু শিল্পী প্রয়োজন। তখন থাকতাম আজিমপুর রোডে একটি মেসে, আমরা কয়েকজন প্রকৌশলী। ছিলেন গোলাম রাব্বানী, আমার রুমমেট। তাঁর মুখ দিয়েই প্রস্তাব এল। খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। কারণ, পাস করে ঢাকা ওয়াসায় চাকরি নেওয়ার আমার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ঢাকার সাংস্কৃতিক জগতেই বিচরণ করা। এই চাকরিতে ঢাকার বাইরে বদলি ছিল না।

যোগাযোগ হলো ড. ইনামুল হকের সঙ্গে। তিনিও আমন্ত্রিত ওই নাটকে অভিনয়ের জন্য। নাটকটির তথা নাগরিক থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে আতাউর রহমানও, যিনি শুরু থেকে এখন অবধি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং দক্ষতার সঙ্গে।
তারিখ ঠিক মনে নেই, তবে সম্ভবত ১৯৬৮-এর শেষের দিকেই প্রচারিত হলো ইদিপাস ঢাকা টেলিভিশনে, শুরু হলো ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর যাত্রা। সে সময়কার সহযাত্রী অনেকের মধ্যে যাঁদের কথা মনে পড়ছে-গোলাম রাব্বানী, ড. ইনামুল হক, সুলতানা কামাল, গাজী সাদেক, ফজলে নিজামী, সিরাজ, আতাউর রহমান (ইদিপাসের চরিত্রে), নাসিমা খান মজলিশ প্রমুখ।

নাটক শেষে গ্রুপটার কাঠামো তৈরি করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল। নানা মিটিং আলাপ-আলোচনা, ইত্যাদি শেষে বড় বড় কিছু নামের মানুষ সরে গেলেন এই গ্রুপ থেকে। আমরা কজনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাসে যোগ করলাম একটি নতুন নাম, ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’।

মঞ্চে আমরা এলাম ১৯৭২ সালে। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকের মাধ্যমে, আতাউর রহমানের পরিচালনায়। ওয়াপদা মিলনায়তনে দুই টাকা-তিন টাকা টিকিটের বিনিময়ে দর্শক এসেছিলেন নাটক দেখতে। এর মাঝে আমরা অবশ্য কয়েকটি রেডিও নাটক করেছিলাম। কিন্তু সেটা তো আমাদের লক্ষ্য ছিল না, মঞ্চই আমাদের আসল জায়গা। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকের মাধ্যমে আমাদের সেই পথ তৈরি হলো। গ্রুপে এলেন আমাদের আজকের একজন প্রধান অভিনয়শিল্পী-আলী যাকের। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার বিখ্যাত সব মঞ্চনাটক দেখে তাঁর রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে, কিছু একটা করে ফেলার জন্য। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-এর ‘গদা’ চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর উৎসাহ বেড়ে গেল। তিনি প্রস্তাব রাখলেন পরবর্তী নাটকটি তিনিই পরিচালনা করবেন। সেটা ছিল বাদল সরকারের লেখা বাকি ইতিহাস। সর্বসম্মতিতে পাস হলো তাঁর প্রস্তাব।

তারপরই তো নাগরিক গড়ল ইতিহাস। দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের পথিকৃতের ভূমিকা পালন করল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। প্রতি রোববার বেলা ১১টায় ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে শুরু। ৪৫ বছর আগের কথা। আশ্চর্য লাগে। কত দিন পেরিয়ে গেল! দিনটি জ্বলজ্বল করছে ইতিহাসের পাতায়, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩।

বাকি ইতিহাস-এর মহড়াকালেই দলে যোগ দিলেন আসাদুজ্জামান নূর। তারপর আরও কতজন এলেন, অনেকে চলেও গেলেন। নাগরিকের সেই তারকাসমৃদ্ধ সময়টা হয়তো আজ নেই, তবে তরুণ প্রজন্ম সেই জন্মকালের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে একে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দৃঢ়প্রত্যয়ে। এটাই আশার কথা।
শুধু এক ৫০ কেন, আরও অনেক ৫০ পেরিয়ে যাবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। জয়তু নাগরিক।

আবুল হায়াত: অভিনেতা, নাগরিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য