Thank you for trying Sticky AMP!!

ঝড়ের দিন আসছে: নগর তৈরি তো?

ফাইল ছবি

গত বছর বৈশাখ মাসে (এপ্রিল ২০১৮) ঢাকাসহ সারা দেশে কালবৈশাখীর তাণ্ডব ছিল স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহ। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ কালবৈশাখীতে বিভিন্ন জেলায় ৬ জন নিহত হন। কোনো কোনো জায়গায় শিলাবৃষ্টি এতটাই প্রবল ছিল যে অনেক ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে যায়। এপ্রিলের ২২ ও ২৯ তারিখের ঝড় যানজটে নাকাল ঢাকা শহরকে অচল করে দিয়েছিল। ২২ এপ্রিলের ১৫ মিনিটের আকস্মিক ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮৩ কিলোমিটারের বেশি। গুলশান-১, মিরপুর-১০, তেজগাঁওয়ের লাভ রোড, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধসহ রাজধানীর প্রায় ৪০–৫০টি স্থানে সড়কে পাশের গাছ পড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়ায় দেয়ালধসের ঘটনাও ঘটে। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়, ন্যাম ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সারি ধরে লাগানো ২০-২৫টি গাছ ভেঙে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এলাকার রাস্তা নিরাপত্তা প্রহরীদের বেশ কিছু টংঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়লে সেগুলো দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যায়।

বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছু এলাকায় ঝড় শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় মধ্যরাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। অন্ধকারে ডুবে ছিল ঢাকার বড় অংশ। অনেক এলাকায় গাছ পড়ে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন ছিঁড়ে যায়। কয়েকটি এলাকায় সাবস্টেশনে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। নারিন্দা, মানিকনগর, সিদ্ধিরগঞ্জ, রামপুরা, বনশ্রী, মগবাজার, তেজগঁাও, পুরান ঢাকাসহ অধিকাংশ এলাকায় পরের দিনও সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। শহরের গাছ কেটে রাস্তা পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি আর অভিজ্ঞ লোকবলের অভাব দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে মানিক মিয়া আর গণভবনের আশপাশের রাস্তাগুলো পরিষ্কার করার জন্য দমকলকর্মীদের কাজে লাগানো হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিভিন্ন পার্ক আর কম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পাশে এমনকি চন্দ্রিমা উদ্যানে মূল থেকে উৎপাটিত ৮৫টি গাছ আর তার ডালপালা সরাতে কেটে যায় অনেকগুলো মাস।

সপ্তাহখানেক পর ২৯ এপ্রিল বৈশাখী পূর্ণিমার দিন ঝড় আর দিনভর বৃষ্টিতে ঢাকা আবার থেমে যায়। এই ঝড়ের সঙ্গে ছিল ঝমঝম বৃষ্টি আর বজ্রপাত। আবহাওয়া অধিদপ্তর দাবি করে, এপ্রিল মাসে এক দিনে ৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টি আগে আর হয়নি। তাদের মতে, আগের বছর মানে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানীতে সর্বোচ্চ ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। শহরের অধিকাংশ সড়কে পানি জমে যায়। বুদ্ধপূর্ণিমার কারণে সরকারি ছুটি থাকায় রাস্তায় যানবাহন কম থাকলেও দুর্ভোগের কমতি ছিল না। রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ, কাজীপাড়া, মিরপুর-১০, বাসাবো, খিলগাঁও, মৌচাক, ধানমন্ডি এলাকার বেশ কিছু এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।

বাসাবো এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়। আরামবাগ এলাকা আর নটর ডেম কলেজের সড়কের থই থই পানিতে নৌকা আর ড্রাম ভাসিয়ে মানুষ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। নাট্যমঞ্চের সামনে সকালেই হাঁটুপানি জমে যায়। একই চিত্র দেখা যায় মালিবাগ রেলগেট এলাকার ডাক্তার গলি, সুপার মার্কেট ও বাড্ডায়।

সে সময় নানা আলোচনায় ঢাকা তথা নগরে–শহরে ভুল প্রজাতির গাছ লাগানো, ভুল জায়গায় ভুলভাবে গাছ লাগানো, লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা না করা, ঝুঁকিপূর্ণ গাছ শনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো কার্যক্রম না থাকা ইত্যাদি কারণ শনাক্ত করা হয়। মাদাগাস্কারের নাতিদীর্ঘ মূলের কথিত কৃষ্ণচূড়া যে আমাদের নগরের সংক্ষিপ্ত কংক্রিটের ফুটপাতে লাগানোর গাছ নয়, সেটা বুঝতে পারলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। চা–বাগানের ছায়া গাছ বা শেড ট্রি দেখতে যত সুন্দরই হোক না কেন, সে চম্বলগাছ যে লোকালয়ে লাগানো ঠিক না, সেটা সিডর–আইলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও আমাদের চোখ খোলে না।

ধানমন্ডিতে গাছের চাপায় মানুষ মরলে আমরা হা–হুতাশ করি লোকটা প্রকৌশলী ছিল বলে (প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান ৫৪)। মৃত্যু ১১ মে ২০১৮—লিখে রাখে কেউ কেউ। গাছ ছিল কম শিকড়ের কিন্তু দৃষ্টিনন্দন কৃষ্ণচূড়া। সকালে হাঁটতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গাছটার নিচে। শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিন্তু সুদর্শন একজন কর্তা সেদিন বলেছিলেন ‘রং প্লেস রং টাইম’–এর নামই বোধ হয় জবাবহীনতার শাসন। মে ১১, ২০১৮ শুক্রবার সকাল ৯টার এ ঘটনা আবার যে ঘটবে না, তা কে নিশ্চিত করবে।

আবারও এপ্রিল এগিয়ে আসছে। কালবৈশাখী আবারও আঘাত হানতে পারে। কিছু একটা করে দেখানো আর ভাবমূর্তি তৈরির ঘোরে ঘুরপাক খাওয়া নগরপিতারা আসন্ন কালবৈশাখী মোকাবিলার একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে কাজ শুরু করতে পারেন। সেই সঙ্গে থাকা দরকার একটা আপত্কালীন পরিকল্পনা। যদি গতবারের মতো এবারও এক দিনে শখানেক গাছ পড়ে যায়, তাহলে কীভাবে কাদের দিয়ে কত তাড়াতাড়ি সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে।

আর গাছ যাতে মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় সে জন্য কোন গাছটা ঝড়ের আগে ছেঁটে দিতে হবে, কোনটাতে প্যালা দিতে হবে, কোন গাছটা সরিয়ে দেশি টেকসই গাছ লাগাতে হবে, হঠাৎ বৃষ্টিতে জল জমে গেলে তার বিকল্প ব্যবস্থা ইত্যাদির একটা পরিকল্পনা ওয়ার্ড কমিশনার আর তাদের সমর্থকদের নিয়ে আগামী ১৫ দিনেই করা সম্ভব। এখনো সময় আছে; সম্ভাব্য কালবৈশাখী মোকাবিলার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। উভয় সিটি করপোরেশনকে এখনই এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে; নিজেদের পর্যাপ্তসংখ্যক বিশেষজ্ঞ না থাকলে এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। উদ্যোগটা নিতে হবে দুই মেয়রের তরফ থেকে। বিশ্বাস করতে চাই যে তঁাদের প্রতিষ্ঠানে করিতকর্মা লোকের অভাব নেই। তবে লোক দেখানো আড়ম্বর নয়, আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য আন্তরিক দায়িত্ববোধ থেকে ফলপ্রসূ পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে এবং তা এখনই। কারণ, ‘সময় বহিয়া যায়।’

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com