Thank you for trying Sticky AMP!!

টিএসসিকে রেহাই দিন, প্লিজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কমপ্লেক্সে সবুজ মাঠ ঘিরে নানা স্থাপনা

মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলো খুলেই দেখতে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, আর তার অংশ হিসেবে টিএসসিকে ভেঙে নতুন করে গড়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র–শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে টিএসসির অবকাঠামো বাড়ানোর প্রয়োজনে তাঁরা এ কাজ করবেন। সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আমাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গার একটি ছিল টিএসসি কমপ্লেক্স। ক্যাফেটেরিয়ায় দুপুরের খাবার, অডিটরিয়ামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা, শীতের সময় মাঠে বসে আড্ডা, এসব ছিল দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বছরে দু–একবার যা এখনো যাওয়া পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা–ও সেই টিএসসিতেই, সাধারণত কোনো ধরনের পুনর্মিলনীতে। সেই টিএসসি অন্য কিছু হয়ে যাবে? মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল।

আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ১৬ হাজার, ৩০টির মতো বিভাগ ছিল। এখন ৮০টি বিভাগ, ছাত্রসংখ্যা অন্তত ৩৫ হাজার। এ সংখ্যা বৃদ্ধি মোটামুটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তুলনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা বাড়েনি। অবকাঠামোর অবস্থা আরও করুণ। এক সিটে দুজন ঘুমানোর ‘ডাবলিং’ প্রথা চালু ছিল তখনো। আমাদের আশা ছিল পরবর্তী প্রজন্ম এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। সে আশা পূরণ হয়নি, বরং আরও করুণ হয়েছে পরিস্থিতি। এস এম হলের কমন রুমে এবং বারান্দার মেঝেতে বিছানা পেতে ছাত্ররা ঘুমায়। সিট পেতে হলে সরকারি দলের মিছিলে যেতে হয়, এমনও শুনতে পাই। অবকাঠামো বাড়ানোর প্রয়োজন তাই অনস্বীকার্য।

আমাদের সংস্কৃতিতে ইতিহাসসচেতনতার স্থান কম। ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল অবজ্ঞা প্রদর্শনেও আমাদের কোনো বিকার নেই। ঢাকা–রাজশাহী মহাসড়কের পাশে বিড়ালদহ মাজারের চমৎকার নির্মাণশৈলীর প্রাচীন ঘরটিকে অবলীলায় চৌকো কুৎসিত এক দালান দিয়ে ঢেকে দিতে তাই বাধে না আমাদের। আশির দশকেও অনেক প্রাচীন সুদর্শন ভবন ছিল পুরান ঢাকায়। ‘উন্নয়নের’ ধাক্কায় তার প্রায় সবই উধাও হয়ে গেছে। পৃথিবীর বড় বড় সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সুযোগ–সুবিধা বাড়িয়েছে, কিন্তু কেউই তাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে তা করেনি (সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি তারা প্রধানত করেছে গবেষণার ক্ষেত্রে)। কার্জন হল এলাকা, এস এম হল, টিএসসি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। টিএসসি হয়তো পুরোনো নয় অত, কিন্তু ষাটের দশকে মার্কিন অর্থায়নে তৈরি এ অনবদ্য স্থাপনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখচ্ছবির অনিবার্য অংশ। আমি ভেবে পাই না কিছু শিক্ষিত মানুষ কী করে এই প্রিয় মুখটিকে কাটাছেঁড়া করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমার ভয় করছে এই ভেবে যে এর পর না এই পরিকল্পকদের দৃষ্টি পড়ে এস এম হলের ওপর! এত বড় জায়গা নিয়ে মাত্র দোতলা ভবন, এত কম ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা, আবার মাঝে বিশাল বাগান। সব ভেঙেচুরে বহুতল দালান বানালেই তো অনেক গুণ বেশি বিছানা ফেলা যায়!

আমরা যখন ছাত্র, শুনেছিলাম একসময় নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। আমার মনে হয় না বাইরের কেউ এ কথা বলত। আর এ তুলনায়, আমার বিশ্বাস, বাস্তবের চেয়ে আমাদের অত্যুক্তি করার প্রবণতাই প্রতিফলিত হয়েছে বেশি। তারপরও আঞ্চলিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজ বিশ্ব দূরে থাক, এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ তালিকার তলানিতে খুঁজতে হয়। শিক্ষার সর্বস্তরে আমরা গুণগত মানের চিন্তা বাদ দিয়ে পরিমাণ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে মগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কাজ জ্ঞান সৃষ্টি। নোবেল পুরস্কার বাদ দিলাম, কতটা জ্ঞান সৃষ্টি করছে, কয়টি কার্যকর পেটেন্ট বেরিয়েছে দেশের এই সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এই আত্মজিজ্ঞাসার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। একটা কথা বলতে খারাপ শোনায়, সবাইকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে এমন তো কথা নেই। সবাই তো অক্সফোর্ডে, কেমব্রিজে পড়ার সুযোগ পায় না। দেশে অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকুক না, যেখানে শুধু সীমিতসংখ্যক উচ্চ মেধাসম্পন্নরাই পড়তে পারবে। অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার, বাকিরা পড়ুক না সেখানেই। আর পিয়ন বা কেরানি হওয়ার জন্য তো এমএ পাস করার কোনো প্রয়োজন নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে আমি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতর পদ্মাপারে ১২০ একর জায়গাজুড়ে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস। মোট ছাত্র মাত্র ৩০০ জন, বছরে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বের হয় ৫০ জন। বিশাল ব্যয়ের এই প্রতিষ্ঠানকে ‘কস্ট ইফেক্টিভ’ করার জন্য অবকাঠামো খাতে ন্যূনতম বিনিয়োগে ধারণক্ষমতা দ্বিগুণ করার একটা প্রস্তাবনা তৈরি করেছিলাম প্রকৌশলী বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে। এ নিয়ে লিখেও ছিলাম ডেইলি স্টার–এ দশ–বারো বছর আগে। সম্প্রতি এরূপ একটি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়েছে। তবে সেখানেও টিএসসির মতো মহাপরিকল্পনা। সব ভেঙেচুরে অনেকগুলো বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। আমাদের পরিকল্পনাকারীরা স্বল্প ব্যয়ের কোনো প্রকল্প পছন্দ করেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা যাঁরা প্রণয়ন করছেন, তাঁদের মানসিকতাও অন্য রকম হবে, তা আশা করছি না। প্রকল্প নিঃসন্দেহে বিশাল ব্যয়ের হবে। তা হোক। ছাত্র–শিক্ষকদের আবাসিক সুবিধা বাড়ান, প্রয়োজনে তা মূল ক্যাম্পাসের বাইরে জায়গা নিয়ে করুন। ব্যাপক সংস্কারকাজ করুন, যাতে শৌচাগারগুলোতে ঢুকলে নাকে রুমালচাপা দিতে না হয়। ফারসি ইনস্টিটিউটের মতো অপ্রয়োজনীয় কাজে জায়গা বরাদ্দ বন্ধ করুন। আর সীমিত এই ক্যাম্পাস নিয়ে ছাত্রসংখ্যা বাড়ানোর ক্ষতিকর তৎপরতার ইতি টানুন। একান্তই যদি ভাঙচুর করতে হয়, তা করুন সাধারণ ভবনগুলো নিয়ে, যেগুলোর তেমন কোনো শৈল্পিক বা স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য নেই।

শুধু ভেঙে গড়ার এই মহাযজ্ঞ থেকে রেহাই দিন আমাদের প্রিয় টিএসসিকে। প্লিজ।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব