Thank you for trying Sticky AMP!!

টিকতে হলে লাইনে আসতে হবে

এই সেদিনও রাজধানীর সিএনজি স্কুটারচালকদের অন্য রকম একটা দাপট ছিল। আলাদা একটা ভাব ছিল। যাত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম ছিল না। যাত্রী কোনো গন্তব্যে যাওয়ার প্রস্তাব করলে সেটা পুরোটাই নির্ভর করত সিএনজিচালকের মর্জির ওপর। ইচ্ছা হলে যেতেন, ইচ্ছা না হলে যেতেন না। আর ভাড়া তো হাঁকাতেন আকাশছোঁয়া। এখনো যে তা চলছে না, তা নয়। মিটারে যেখানে ভাড়া উঠবে ৭০-৮০ টাকা, সেখানে অবলীলায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা হাঁকেন তাঁরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিমান্ড থেকে একচুলও নড়েন না। অসহায় যাত্রী তখন মুখ ব্যাদান করে ওই ভাড়াতেই যেতে রাজি হন। কারণ, যেতে তো হবে। ব্যতিক্রম থাকলেও এটাই ছিল গড়পড়তা যাত্রী-অভিজ্ঞতা।

রাজধানীতে সিএনজি স্কুটারে যাতায়াত করা যাত্রীদের এমন অভিজ্ঞতা কমবেশি রয়েছে। অনেকে এ পরিস্থিতিকে জিম্মিদশার সঙ্গে তুলনা করেন। অনেক যাত্রীর অভিযোগ, বিপদে পড়লেও ছাড় দেন না এসব স্কুটারচালক। বরং রোগী দেখলে বা বিপদগ্রস্ত যাত্রী পেলে কিছু স্কুটারচালক ভাড়া আরও বেশি হাঁকেন। এভাবে স্কুটারের জগতে একরকম একক সুবিধা ভোগ করে আসছেন তাঁরা। তাঁদের এ স্বেচ্ছাচারিতায় বাগড়া দিয়েছে অ্যাপভিত্তিক পরিবহনসেবা উবার ও পাঠাওয়ের গাড়ি আর মোটরবাইক। স্মার্টফোনে এসব সেবাদাতার অ্যাপ ডাউনলোড করলে বিরাট সুবিধা। যাত্রী কখন কোন গন্তব্যে যাবেন, কোথায় কত ভাড়া, তা অ্যাপের মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়। আর গাড়ি বা মোটরসাইকেল প্রস্তাবকারী যাত্রীর ঠিকানায়ও দ্রুত পৌঁছে যায়। ভাড়া নিয়ে খেঁচাখেঁচির কোনো বিড়ম্বনা নেই। যাত্রী স্বচ্ছন্দে গাড়ি বা বাইকে উঠে চলে যাবেন গন্তব্যে।

এসব যানে যাতায়াতেও বেশ আরাম। উবারের গাড়িতে রয়েছে তাপানুকূল সুবিধা। বেশ আরামে বসে যাওয়া যায়। ধুলো-ধোঁয়ার যন্ত্রণা নেই। যদিও ভাড়াটা একটু বেশিই। আর পাঠাওয়ের মোটরসাইকেল জ্যামের মধ্যেও ফাঁকফোকর গলে দ্রুত চলে যায় গন্তব্যে। স্কুটারের ভাড়া যেখানে ২০০ টাকা, পাঠাওয়ের বাইক নেয় মাত্র ৬০-৭০ টাকা। আর্থিক দিক দিয়েই কেবল সুবিধা নয়, সময়ও বাঁচে। স্কুটারে যাতায়াতে যাঁদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, উবার আর পাঠাওয়ের নতুন ধরনের সেবা পছন্দ না করে উপায় নেই।

এটা ঠিক যে নিয়মমাফিক যাতায়াতে সিএনজি স্কুটারের চেয়ে উবারের দুই ধরনের গাড়িতে যাতায়াতে ভাড়া বেশি পড়ে। কিন্তু উবার নিয়মিত যাতায়াত করা যাত্রীদের দফায় দফায় ছাড় দিয়ে তা অনেকটাই পুষিয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে আয়েশি ভ্রমণ ও তুলনামূলকভাবে অধিক নিরাপত্তার বিষয় তো আছেই।

সিএনজি স্কুটারে যাতায়াত বা ভ্রমণ সে তুলনায় অতটা আরামদায়ক নয়। বরং দুই পাশের ফোকরওয়ালা দরজা আটকে স্কুটার যখন ছাড়ে, যাত্রী তখন আক্ষরিক অর্থেই চলন্ত খাঁচার অসহায় প্রাণীতে পরিণত হন। এ খাঁচার দরজা খোলা ও লাগানোর নিয়ন্ত্রণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাকে চালকের হাতে। কাজেই জরুরি কোনো মুহূর্তে যাত্রীর যখন বের হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন কিন্তু ঝুঁকি থাকছে পুরোমাত্রায়। যদিও এ ব্যবস্থা যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য, তবু এ আয়োজন কোনোভাবেই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। স্কুটারে এই নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার আগে কত যাত্রী যে ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছেন, এর কোনো হিসাব নেই। তবে এই নিরাপত্তাব্যবস্থাও যাত্রীদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ নয়। স্কুটারের রেক্সিনের ছাউনি কেটেও হামলা চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এ জন্য অনেক স্কুটারে ছাউনির নিচে তারের জাল বসানো হচ্ছে।

অন্যদিকে, সিএনজি স্কুটারের মিটারে যে ভাড়ার বিষয়টি রয়েছে, বলতে গেলে কোনো চালকই তা মানেন না। স্কুটারের মালিক, চালক ও যাত্রীদের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় ভাড়া বাড়িয়েও লাভ হয়নি। ওই প্রথম দিকে দু-এক দিন নির্দিষ্ট হার মেনে মিটার ধরে চালকেরা ভাড়া নেন। পরে মিটারে ওঠা ভাড়ার টাকা ওপর ১০-২০ টাকা বেশি দেওয়ার অনুরোধ জানান। এর সঙ্গে অনুরোধের নামে একধরনের ওয়াদা করান, ট্রাফিক সার্জেন্ট ধরলে বলতে হবে যে মিটারে যাচ্ছেন, মৌখিক চুক্তিতে নয়। এভাবে দু-এক সপ্তাহের মধ্যে আগের সেই ‘মগের মুল্লুকে’ ফিরে যান তাঁরা। ভাড়াটা হয়ে যায় লাগামছাড়া। চলছে এভাবেই।

স্কুটারচালকেরা বলেন, পুরো এক দিন চালালে মালিককে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। এ ভাড়ার জোগান দিতে গিয়েই মিটারের রিডিংয়ের সঙ্গে তাল রাখা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে মালিকদের ভাষ্য, নতুন একটি সিএনজি স্কুটার কিনতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা লেগে যায়। পুরোনোটা কিনতেও ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগে। এখানে-সেখানে টাকা ঢালতে হয়। এই টাকা তো তুলতে হবে!

এখন স্কুটারের মালিক ও চালকেরা যেখানে নিজেদের বুঝ বুঝবেন, যাত্রীদের বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে ফায়দা লুটবেন, সেখানে যাত্রীরাও নিশ্চয়ই অসহায়ত্ব কাটিয়ে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে চাইবেন। এখন যাত্রীসেবায় সিএনজি স্কুটারকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে উবার ও পাঠাওয়ের মতো পরিবহন সেবাদাতাদের সঙ্গে। এখানে উবার বা পাঠাও না থাকলে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অন্য কোনো অ্যাপভিত্তিক সেবাদাতা আসবে। যুগের দাবি, সময়ের দাবি এড়ানো যাবে না। কাজেই আন্দোলন করে উবার বা পাঠাওকে কতটা দমিয়ে রাখা যাবে, তা স্কুটারের মালিক ও চালকেরাই ভালো জানেন। যেকোনো আন্দোলনের মূল শক্তি জনতা। জনতা বা যাত্রী পক্ষে না থাকলে আন্দোলনে কোনো কাজ হবে না। উবার-পাঠাও বন্ধের দাবিতে সিএনজি ধর্মঘট নিয়ে প্রথম আলোর পাঠক প্রতিক্রিয়া নানা মন্তব্য পাওয়া গেছে। পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে পাঠকেরা এ ব্যাপারে যেসব মন্তব্য করেছেন, এর দু-একটা নমুনা এখানে দিই।

মোহাম্মদ ইসকান্দার মির্জা নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমি সদরঘাট থেকে মতিঝিলের কথা এখনো ভুলিনি, ৩৫০ টাকা ভাড়া নিয়েছিল। মিটারে মাত্র ১৪০ টাকা উঠছিল।’

রবিউল আলম লেখেন, ‘সিএনজি অটোরিকশাচালকেরা আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের দীর্ঘদিন জিম্মি করে রেখেছিল। উবার, পাঠাও এসে সিএনজিওয়ালাদের যন্ত্রণা থেকে আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের মুক্তি দিয়েছে।’

যাত্রীসাধারণ উবার বুঝবেন না, পাঠাও দেখবেন না, তাঁরা বুঝতে চাইবেন কোন যানবাহনে যাতায়াতসুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। একজন চাকুরের সাতসকালে ব্যস্ত কোনো এলাকায় থাকা অফিসে যেতে হবে, এ সময় কোনা স্কুটারচালক তাঁকে বিমুখ করলে নিশ্চয়ই তিনি ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবেন না। একজন পরীক্ষার্থীর শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া দরকার, যানবাহন–সংকট, এর মধ্যে একজন স্কুটারচালক মুখের ওপর ‘না’ বলে দিলেন, কেমন লাগবে তখন?

এসব বিমুখ মানুষ যখন অসহায়ত্বের সাগরে খাবি খাবি খেতে খেতে উবার বা পাঠাওয়ের মতো খড়কুটো পাবেন, চোখ বুজে সজোরে আঁকড়ে ধরবেন—এটাই বাস্তবতা। আর প্রযুক্তি দিন দিন যত উন্নতির সোপানে পা দেবে, অ্যাপনির্ভর যানবাহন ততই জনপ্রিয় হবে। যেমন একসময়ের হরফ বসানো মুদ্রণযন্ত্র এখন আর চলে না। চললেও ব্যবহার খুবই কম। মুদ্রণশিল্পে এখন কম্পিউটারে বসানো সফটওয়্যারের অবাধ রাজত্ব। তেমনি প্রযুক্তির উৎকর্ষ যত বাড়বে, পরিবহন খাতও তত অ্যাপনির্ভর হবে। সেখানে সিএনজি স্কুটারের দাপট দিন দিন এমনিতেই কমে যাবে। এখানে এই যন্ত্রযানের লক্ষ্য হওয়া উচিত অধিকতর যাত্রীবান্ধব হওয়া। তারা যদি ভাড়া সহনীয় করাসহ অন্যান্য সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে যাত্রীবান্ধব হতে পারে, তবেই টিকে থাকতে পারবে; নইলে নয়।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক, সাংবাদিক
sharifrari@gmail. com