Thank you for trying Sticky AMP!!

টোনা আর টুনির নতুন গল্প ২০২০

ছবি: প্রথম আলো

১ জানুয়ারি ছিল পাঠ্যপুস্তক দিবস। আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের হাতে বছরের প্রথম দিন নতুন রঙিন বই তুলে দেওয়া হয়। এত বড় ঘটনা পৃথিবীতে আর ঘটে না। ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’-এর মাধ্যমে সারা দেশে প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে নতুন ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে।

গতকাল কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় রঙিন বই হাতে ছেলেমেয়েদের দেখে মন আনন্দে ভরে উঠল।

বাচ্চাদের হাতে রঙিন বই দেখে মনে পড়ল, ছোটবেলায় আমাদের বাংলা বইয়ে একটা গল্প ছিল। টোনা আর টুনি।

এক ছিল টোনা। আরেক ছিল টুনি। টোনা কহিল, টুনি, পিঠা তৈরি করো।

টুনি কহিল, তেল আনো, গুড় আনো, চাল আনো, তবে তো পিঠা।

টোনা বাজারে গেল। আটা, গুড়, তেল আনিল।

টুনি বেগুনগাছে বসিয়া পিঠা তৈরি করিতে লাগিল। পাশের বাড়ি হইতে আগুন আনিল।

এই সময় এক বিড়াল আসিল। কহিল, টোনা ভাই, তোমার বউ কী রাঁধিতেছে। ভারি খুশবু ছুটিয়াছে।

টোনা কহিল, পিঠা বানাইতেছে। তুমি বিকালে আসিও। তোমাকেও ভাগ দিব।

ইহার পর একে একে কুকুর আসিল, শিয়াল আসিল, বাঘ আসিল, সকলকেই টোনা একই কথা বলিয়া বিদায় দিল।

দুপুরের মধ্যে টোনা আর টুনি পিঠা তৈয়ারি করিয়া খাইয়া-দাইয়া সবকিছু সাফ করিয়া একটা বড় আমগাছের মগডালে উঠিয়া বসিয়া থাকিল।

বিকালে বিড়াল আসিল, কুকুর আসিল, শিয়াল আসিল, বাঘ আসিল, আসিয়া দেখিল কেহই নাই, কিছুই নাই।

তাহারা মনের দুঃখে বিদায় লইল।

টোনা আর টুনি ডাকিয়া উঠিল টুন টুন টুন।

এই গল্প বেশ কিছুদিন চলল। তখন নীতিবাগীশেরা বলে উঠলেন, কোমলমতি শিশুরা এই গল্প থেকে কী শিখবে? প্রতারণা। কথা দিয়ে কথা না রাখা! স্বার্থপরতা।

তখন গল্পটা বদলে ফেলা হলো। এরপর গল্পটা দাঁড়াল, টোনা আর টুনি পিঠা বানাল। তারপর সুন্দর করে সবার জন্য থালায় থালায় সাজিয়ে রাখল। বিকালে পশুপাখিরা এল। সবাইকে টোনা আর টুনি পিঠা পরিবেশন করল। খেয়ে বনের পশুপাখি সবাই খুশি হয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগল।

পরে অবশ্য এই গল্প বাদ দেওয়া হয়।

এখন এই গল্প যদি লিখতে হয়, তাহলে কীভাবে লেখা যাবে? এক. টোনা বলতেই পারবে না, টুনি তুমি পিঠা তৈরি করো। এখন নারী-পুরুষের সাম্যের যুগ। মেয়েরা রাঁধবে, আর পুরুষেরা কেনাকাটা করতে যাবে, সেই দিন আর নেই। কাজেই দুজনে মিলে ঠিক করবে, আজ দুপুরে হবে পিঠা। আজ পিঠা দিবস। তারপর দুজনে মিলেই বাজারে যাবে। তারপর দুজনে মিলেই পিঠা তৈরি করতে থাকবে।

তারও আগে তারা একটা ইভেন্ট পেজ খুলবে। মেসেঞ্জারে বা হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলবে। আমরা পিঠা দিবস করতে যাচ্ছি। কে কে আসবেন। গোয়িং, ইন্টারেস্টেড ইত্যাদি দেবে কেউ কেউ।

তারপর হয়তো একজন বলবে, আচ্ছা, আমি আসার সময় কিছু পুলি পিঠা নিয়ে আসব। কেউ হয়তো বলবে, চিতই পিঠা দিয়ে খাওয়ার জন্য শর্ষেবাটা আমিই আনছি। কেউ হয়তো বলবে, ড্রিংকসের দায়িত্ব আমার।

বিকেলে সব পশুপাখি আসবে। সবাই মিলেমিশে পিঠা খাবে।

তার আগে সব খাবার সাজিয়ে ফটো তোলা হবে। সেই ফটো ফেসবুকে প্রকাশ করা হবে। তারপর খেতে খেতে হয়ে যাক একটা সেলফি।

বিড়াল বলবে, টোনা ভাই টোনা ভাই, আপনাদের ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ডটা দিন না!

টোনা বলবে, পাসওয়ার্ড তো আমি মুখস্থ রাখি না। আমার ছেলেটা ওটা মুখস্থ রাখে। ও কই? টুনাইয়া টুনাইয়া কই গেলা। আসো তো এদিকে। আঙ্কেলকে ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড দাও। টুনাইয়া এগিয়ে আসবে। মোবাইলটা আমাকে দিন। আমি পাসওয়ার্ড দিয়ে দিচ্ছি।

ওদিকে বিড়ালের ছোট ছেলে বলে ফেলবে, লাগবে না বাবা। পাসওয়ার্ড আবিষ্কার করে ফেলেছি। টুনাইয়া ২০১৮। ২০১৮ ওর জন্মদিন।

এই নিয়ে টুনাইয়ার মন খারাপ।

রাতে সে বলল, বাবা, বিড়াল আঙ্কেলের ছেলে পুষনটা এত খারাপ কেন? আমার পাসওয়ার্ড সে কেন বের করে ফেলল।

টোনা বলল, টুনাইয়া, এতে মন খারাপ কোরো না। ও আমাদের একটা শিক্ষা দিল। তা হলো, পাসওয়ার্ড কীভাবে শক্তপোক্ত করে দিতে হয়। আরেকটা শিক্ষাও সে দিল।

যেকোনো পাসওয়ার্ডই ভাঙা যায়। কাজেই আমাদের অনলাইনে সব সময় সাবধান থাকতে হবে!

এই গল্প পড়ে তোমরা কী শিক্ষা পেলে?

ইন্টারনেট নিরাপত্তা একটা বড় বিষয়। আমাদের সাবধানে নিরাপদভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা শিখতে হবে।

২.
আমাদের দেশের প্রায় সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের তুলনায় বেশি। এর একটা কারণ উপবৃত্তি।

২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সব স্কুলে দুপুরের খাবার দেওয়ার কর্মসূচি সরকার হাতে নিয়েছে। রান্না করা খাবারের বদলে পুষ্টিসম্পন্ন বিস্কুট দেওয়া হবে।

তাতে নিশ্চয়ই সুফল পাওয়া যাবে।

এই গল্পটা আপনাদের দুবার বলেছি। আরেকবার বলি। কলসিন্দুর গ্রামের যে ফুটবলার মেয়েরা এসএ কাপের আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া জাতীয় দলে খেলত, তাদের নিয়ে প্রথম আলো কয়েক বছর আগে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিল। তাদের বলা হয়েছিল, তোমরা যে শুটিংয়ে অংশ নিচ্ছ, পরিশ্রম করছ, তোমরা আমাদের কাছে কী চাও?

তারা বলেছিল, এক বেলা পেটভরে খেতে চাই।

তাদের বলা হলো, আরও বেশি কিছু চাও।

তারা বলল, তাহলে আমাদের পেটভরে এক বেলা খাওয়াবেন, আর কিছু খাবার আমাদের দিয়ে দেবেন। আমরা বাড়িতে নিয়ে যাব। আমাদের ভাইবোনেরাও যেন এক বেলা পেট পুরে খেতে পারে।

জাতীয় তথ্য বাতায়নে দেখতে পাচ্ছি, ২০১১ সালের পঞ্চগড় জেলার সরকারি প্রতিবেদন। ৩০ ভাগ ছেলেমেয়ে না খেয়ে স্কুলে আসে।

আর এদিকে ২০১০ থেকে ২০১৬-তে দেখা যাচ্ছে দিনাজপুর জেলার দারিদ্র্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি ছেলেমেয়ে না খেয়ে স্কুলে আসে বলে আশঙ্কা করা যায়।

২০২৩ সালের মধ্যে সব স্কুলে মিড-ডে মিল চালু করার কর্মসূচিকে তাই সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। আর তা যদি হয় রান্না করা গরম খাবার, তাহলে তো কোনো কথাই নেই!

এক ছিল টোনা। আরেক ছিল টুনি। তারা তাদের গ্রামের স্কুলের জন্য খাবার রাঁধে। গরম-গরম খিচুড়ি, ডিম, সবজি। দুপুরে স্কুলের ছেলেমেয়েরা পেট ভরে খিচুড়ি খায়।

তাদের খাওয়া দেখে টোনা আর টুনি চোখ মোছে। দুঃখে নয়, আনন্দে। এই অশ্রু আনন্দের অশ্রু। গ্রামের সব পশুপাখি সে দৃশ্য দেখে হাততালি দেয়, পা তালি দেয়, পাখা তালি দেয়। তাদের চোখও আনন্দাশ্রুতে ঝলমল করে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক