Thank you for trying Sticky AMP!!

ট্রাম্পের মোকাবিলায় ডেমোক্র্যাটরা প্রস্তুত?

প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে আছেন বামপন্থী বলে পরিচিত বার্নি স্যান্ডার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এখনো দেড় বছরের মতো বাকি। কিন্তু মার্কিন রাজনীতি এখন আবর্তিত হচ্ছে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মার্কিন রাজনীতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে দেশের রাজনীতি কার্যত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই চলতে থাকে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরদিন থেকেই আলোচনার সূত্রপাত হয় আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থী কারা। আর এখন হচ্ছে সেই সময়, যখন সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের মনোনয়নের লড়াইয়ে নিজেদের নাম ঘোষণা করছেন, প্রচার করছেন, অর্থ সংগ্রহ করছেন।

ইতিমধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন চেয়ে নিজের নাম ঘোষণা করেছেন ২৪ জন। এর আগে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হতে এত বেশি সংখ্যক রাজনীতিবিদ নিজের নাম ঘোষণা করেছিলেন বলে স্মরণ করা যায় না। তার চেয়েও বেশি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এর মধ্যে এমন সব ব্যক্তিও আছেন যাঁরা অতীতে অবধারিত প্রার্থী বলেই বিবেচিত হতে পারতেন। আবার এমন সব ব্যক্তিও আছেন, যাঁরা স্থানীয় রাজনীতিতে সুপরিচিত হলেও তাঁদের জাতীয় পরিচিতি প্রায় শূন্যের কোঠায়।

 ২০১৬ সালের রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতার প্রতিযোগিতায় এমনই দেখা গিয়েছিল—সংখ্যা ছিল বেশি, শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে কম সম্ভাবনাময় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু প্রার্থীই হয়েছিলেন তাই নয়, বিজয়ীও হয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা ডেমোক্র্যাটদের উৎসাহিত করেছে কি না, আমরা তা কেবল অনুমান করতে পারি। কিন্তু একটা পার্থক্য হচ্ছে যে সেই সময়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন না। এখন সেই অবস্থা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এত বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী দেখে মনে হতে পারে যে সবাই ভাবছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারানো দুরূহ হবে না। এই ধারণার পেছনে অবশ্যই এটা কাজ করছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ। তাঁর প্রায় কোনো আচরণই যে প্রেসিডেন্টসুলভ নয়, তা তাঁর বিরোধীরা এবং গণমাধ্যম অহর্নিশ বলছে। কিন্তু তাঁর কট্টর সমর্থকেরা তাতে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি রিপাবলিকান পার্টির আইনপ্রণেতারা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই আছেন।

সাম্প্রতিক কালে রবার্ট ম্যুলারের প্রতিবেদনে নির্বাচনে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তাতে ট্রাম্পের লোকজন যোগসাজশ করেছিলেন, তা আইনিভাবে প্রমাণের মতো কিছু পাওয়া যায়নি। ট্রাম্প ‘অবসট্রাকশন অব জাস্টিস’ বা বিচারকাজে বাধা দিয়েছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে গেছে। এই বিষয় নির্ধারণের দায়িত্ব বর্তেছে কংগ্রেসের ওপর। ডেমোক্র্যাটদের একাংশ প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ বা সংসদীয়ভাবে বিচারের পক্ষে, অন্য পক্ষ মনে করে, তাদের উচিত হবে এখন সামনের নির্বাচনের দিকে তাকানো। এখন পর্যন্ত কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে এতটা সমর্থন নেই, তাঁরা রিপাবলিকানদের বাদ দিয়েই এই বিচার করতে পারবেন।

ইমপিচমেন্ট প্রশ্ন দলের ভেতরে যে ভিন্ন ভিন্ন মত তৈরি করেছে তাঁর কারণ হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের বেআইনি আচরণের বিচার না করা হলে আইনের শাসন রক্ষায় কংগ্রেস তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ বলেই মনে হবে, যা ডেমোক্র্যাটদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে। এমনকি সামনের কংগ্রেস নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পথে বাধা হয়েও দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে তারা যদি ইমপিচমেন্ট করার দিকে নজর দেয়, তাতে ভোটারদের একাংশের মনে হতে পারে যে ডেমোক্র্যাটরা ‘বাড়াবাড়ি’ করছে। তাদের উচিত এমন সব বিষয়ে নজর দেওয়া, যেগুলো সাধারণ মানুষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, যেমন স্বাস্থ্যবিমা।

ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে ওবামা কেয়ারে এমন সব বদল করেছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে। এখন প্রশাসন আদালতের মাধ্যমে এই স্বাস্থ্যবিমা একেবারে বাতিল করে দিতে চাইছে। সব জনমত জরিপেই দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। ফলে অনেকেই ডেমোক্র্যাটদের সেই ক্ষোভ কাজে লাগানোর দিকে নজর দেওয়াকে সঠিক বলে মনে করেন। ম্যুলারের তদন্ত প্রতিবেদনের বাইরেও প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের আয়কর ও অন্যান্য বিষয়ে তদন্ত করছেন।

ট্রাম্পের এসব বিপদের কারণেই অনেকের ধারণা হতে পারে, ২০২০-এর নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, আসলে ডেমোক্র্যাটদের জন্য ২০২০ সালের নির্বাচন অনুকূলে নয়। তার দুটি কারণ আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি।

 পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এমন প্রেসিডেন্টদের পরাজিত হওয়ার ইতিহাস খুব বেশি নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ পর্যন্ত ১০ জন প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছেন। তাতে ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন, মাত্র ৩ জনকে পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়েছে। আরও পেছনে ফিরে ইতিহাস দেখলেও ডেমোক্র্যাটদের জন্য খুব ইতিবাচক কিছু খবর নেই। ১৯০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৯ জন প্রেসিডেন্ট আবারও ক্ষমতায় থাকার জন্য ভোটারদের সমর্থন চেয়েছেন, তার মধ্যে ভোটাররা ১৪ জনকে বিজয়ী করেছেন। আর যে পাঁচজনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তার মধ্যে জেরাল্ড ফোর্ডও আছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ফোর্ড প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হননি, ফলে তাঁকে যদি বাদ দেওয়া যায় তবে পরাজিত প্রেসিডেন্টের সংখ্যা আরও কমবে। ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট এইচ ডব্লিউ বুশকে হারিয়ে বিল ক্লিনটন বিজয়ী হয়েছিলেন বলে এ কথা মনে করার কারণ নেই যে ডেমোক্র্যাটদের এই বিষয়ে রেকর্ড ভালো। কেননা, এর আগের ঘটনা হচ্ছে ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টারকে হারিয়ে রোনাল্ড রিগ্যান বিজয়ী হন, ১৯৮০ সালে।

 দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এ ক্ষেত্রেও ইতিহাস তার পক্ষে নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যতজন প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই দেশে বেকারত্বের হার ছিল কম। ১৯৫৬ সালে ডুয়াইট আইজেনহাওয়ার, ১৯৬৪ সালে লিন্ডন জনসন, ১৯৯৬ সালে বিল ক্লিনটন এবং ২০০৪ সালে জর্জ বুশ যখন প্রার্থী হয়েছেন, তখন বেকারত্বের হার কম, মুদ্রাস্ফীতি কম ছিল। ১৯৮৪ সালে রিগ্যানের দ্বিতীয় নির্বাচনের সময় বেকারত্বের হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ, কিন্তু সেই হার কমতে শুরু করেছিল। রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে অর্থনৈতিক অবস্থার ইতিবাচক ধারা হওয়ার মুখেই এক বিশাল বিজয় অর্জন করেছিলেন। এর বিপরীতে ১৯৭৬ সালে জেরাল্ড ফোর্ড মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা সামলাতে পারেননি। জিমি কার্টারের পরাজয়ের পটভূমিকা আমাদের জানা, একটি যুদ্ধে জয়ী হয়েও জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ পরাজিত হয়েছিলেন ক্লিনটনের কাছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা তাঁদের আমলের শেষ দুই বছরে যদি বেকারত্ব কমাতে পারেন, তবে তাঁরা বিজয়ী হন। মোদ্দা কথা, ভালো অর্থনীতিতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে হারানো প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন এবং মার্কিন রাজনীতি কোনোটাই স্বাভাবিক নয়। ডেমোক্র্যাটদের শীর্ষ নেতা প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি প্যালোসি বলেছেন, দেশে সাংবিধানিক সংকট চলছে। সেই সংকটের কথা যদি আপাতত সরিয়েও রাখি এবং ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে অবস্থা যে বিরল তা বোঝা যাবে। এই রকম অবস্থায় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের সমর্থন থাকার কথা ইতিবাচক। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তা উল্টো। যেকোনো প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার তুলনায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে কম। ফাইভথার্টিএইট ওয়েবসাইট এ ধরনের জনপ্রিয়তার একটি তুলনামূলক হিসাব দিয়েছে। প্রেসিডেন্টদের ৮৪০ দিনের মাথায় ট্রাম্পের অ্যাপ্রুভাল রেটিং হচ্ছে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ, একই সময়ে বারাক ওবামার ছিল ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ, জর্জ বুশের ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ, বিল ক্লিনটনের ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ। জিমি কার্টারের ছিল ৩৭ শতাংশ। ৫১ শতাংশের চেয়ে কম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট বিজয়ী হননি, ব্যতিক্রম হচ্ছেন রিগ্যান, তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ৪২ শতাংশ। শুধু তা–ই নয়, যেসব অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাটদের জেতার কথা কিন্তু ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন, যেমন মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, আইওয়া, সেখানেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অ্যাপ্রুভাল রেটিং নেতিবাচক।

এসব বিবেচনায় নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা কী ধরনের কৌশল নির্ধারণ করেন, তার ওপর তাঁদের জয়ের সম্ভাবনা নির্ভর করছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের এই বিশাল তালিকা তাঁদের জন্য ইতিবাচক নয়। একই সঙ্গে তাঁদের প্রার্থীদের পারস্পরিক আক্রমণের আশঙ্কা যতই বাড়ছে, ততই তা দলের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। আদর্শিক অবস্থানের বিশুদ্ধতা বা আইডিওলজিক্যাল পিউরিটির চেয়ে জয়ের দিকে নজর দেওয়াই ডেমোক্র্যাটদের প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। সর্বোপরি দল যদি দীর্ঘ প্রাইমারি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে, তবে তা ডেমোক্র্যাটদের জন্য আত্মঘাতী হবে।

 আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর