ঢাকার জন্য উন্নত সরকারি সেবা
>
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথমআলো।
আজ প্রকাশ করা হলো সপ্তদশ নিবন্ধটি।
বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। একই সঙ্গে ঢাকা শুধু বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটিতেই পরিণত হয়নি, এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে অপরিকল্পিত মহানগরগুলোর মধ্যে একটি। ১ দশমিক ৮ কোটি জনসংখ্যার এই শহরটির এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ দরিদ্র। এদের বেশির ভাগ মহানগরীর বস্তি এলাকায় বসবাস করে। জাতিসংঘ পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০৫০ সাল নাগাদ আরও অতিরিক্ত ২ কোটি মানুষ ঢাকায় বসবাস করবে, যা জনসংখ্যার ঘনত্ব আরও অনেক বৃদ্ধি করবে।
এ ধরনের দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ অনেক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। শহরের অর্ধেক বর্জ্য কেবল নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করা হয়। মহানগর এলাকার নদী ব্যবস্থা এতই দূষিত হয়ে গেছে যে এগুলো মানুষ ও পশু উভয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথাযথ পানিনিষ্কাশনব্যবস্থার অভাবে নিয়মিতভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা পরিবহন ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বিঘ্নিত করে।
‘বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ’ প্রকল্প রাজধানীর দ্রুত ও মূলত অপরিকল্পিত বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী হতে পারে, সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার ও ব্র্যাকের যৌথ অংশীদারত্বের এই প্রকল্প যানজট ও শিক্ষা থেকে শুরু করে ভূমি রেকর্ড ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত বিস্তৃত সমস্যাগুলোর সবচেয়ে আশাপ্রদ সমাধান নিয়ে গবেষণা করতে দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বেশ কিছু শীর্ষ অর্থনীতিবিদ নিযুক্ত করেছে। এর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ কীভাবে এর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় ব্যয় করা প্রতি টাকায় সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করতে পারে, তা খুঁজে বের করা।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ডের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খোরশেদ আলমের করা গবেষণায় রাজধানী ঢাকায় তিনটি প্রবৃদ্ধি-সংশ্লিষ্ট সমস্যার মোকাবিলা করতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় অনুসন্ধান করা হয়েছে। এগুলো হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদী পুনরুদ্ধার ও পানিনিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন। ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা থেকে যথাযথভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় না। ফলে শহরের প্রায় অর্ধেক কঠিন বর্জ্য রাস্তার ধারে, খালে অথবা নিচু এলাকায় ফেলা হয়, যা পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক খোরশেদ আলমের করা গবেষণায়।
এই বিনিয়োগের একটি দিক হলো উৎস থেকে বর্জ্য বাছাই করা, যা হয় পুনর্ব্যবহারের অথবা কঠিন বর্জ্য নিরাপদে মাটিচাপা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া বর্জ্য থেকে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে, ফলে আয়ের উৎস তৈরি হবে। বর্জ্য কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর কারণে মাটিচাপা দেওয়ার খরচটাও বেঁচে যাবে। মোট ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের ১০টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অ্যানারোবিক কম্পোস্টিং এবং বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণ করা যাবে। এই টাকাতেই পাশাপাশি বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিচালনা বাবদ অতিরিক্ত খরচের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। ৬৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগে লাভ হবে ৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
বুড়িগঙ্গা নদীর পুনরুদ্ধারে অর্থায়ন করা এই বর্জ্য সংশ্লিষ্ট একটি সমাধান হতে পারে। গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্যের কারণে এই নদীর পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে তা একইভাবে মানুষ ও মাছের ক্ষতিসাধন করছে। এই নদী পুনরুদ্ধার করতে আনুমানিক ব্যয় হবে ৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। প্রথমে নদীর জন্য একটি বর্জ্যপানি পরিশোধন প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে হবে। এতে আনুমানিক ব্যয় হবে ২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া এতে প্রয়োজন হবে নদী খনন, জমির উচ্চতা বাড়ানো, অবৈধ স্থাপনা স্থানান্তর, নর্দমা অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং একটি আরও মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করতে নদীরদুই ধারে চলার পথ ও বসার বেঞ্চ তৈরি করা।
নদী পরিষ্কার ও এর চারপাশের পরিবেশ উন্নত করলে তা নিকটবর্তী বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ হবে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা খাতে যে ৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ব্যয় হতো, তা বেঁচে যাবে। এতে নদী এলাকার জমি ও বাড়িঘরের দামও বাড়বে, বিনোদনমূলক কাজের ব্যবস্থা হবে এবং পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হবে, আরও মাছের আবাস তৈরি হবে। ১২ হাজার ৮২০ কোটি টাকার সামগ্রিক সুবিধাসহ, নদী পুনরুদ্ধার ব্যবস্থায় ব্যয় করা প্রতি টাকা প্রায় ১ দশমিক ৫ টাকার সুবিধা দেবে।
সর্বশেষ গবেষণাটি বর্ষাকালে ঢাকার পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখেছে, যার আওতায় বর্তমানে ঢাকার মাত্র ৩৯ শতাংশ এলাকা আছে। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষ নিয়মিত জলাবদ্ধতার মুখে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা তুলে ধরে যে আগামী দশকগুলোতে ঢাকা বন্যার দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর একটি হবে।
নগরীর পানিনিষ্কাশনব্যবস্থার সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ঘটাতে পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ, পাইপ ও স্লুইসগেট নির্মাণ এবং কিছু নির্দিষ্ট খাল পুনঃখনন করতে হবে। এতে ৬৮৩ কোটি টাকার প্রয়োজন—এই বিনিয়োগ অর্থনৈতিক ও পরিবহন খাতে প্রতিবন্ধকতা কমাবে, কারণ বন্যার সময় আক্ষরিক অর্থেই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে ব্যয়িত প্রতি টাকায় এই বিনিয়োগ দুই টাকার সামাজিক কল্যাণ সাধন করবে।
যদি আপনি দায়িত্বে থাকতেন ও বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ করতে চাইতেন, ঢাকার জন্য এসব অবকাঠামোগত বিনিয়োগগুলো কি আপনার তালিকার প্রথমে থাকত? <https://copenhagen. fbapp. io/urbanpriorities>-এখানে আমরা আপনার বক্তব্য শুনতে চাই। আমরা ব্যয়িত প্রতি টাকায় কীভাবে সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করা যায়, তা নিয়ে কথোপকথন চালিয়ে যেতে চাই।
ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।