Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাবি বনাম জাবি, কিসের কাজিয়া?

একটি সংবাদে চোখ আটকে গেল। খবরের ভেতরে গিয়ে দেখলাম, মদ্যপানের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কয়েক শিক্ষার্থীকে আটক করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কর্তৃপক্ষ। তাঁদের নামধাম দিয়ে আবার জাবিতে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েও দিয়েছে জাবি কর্তৃপক্ষ। এর কয়েক দিন আগে আবার জাবির কয়েক শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে আটক করে পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধেও মাদকসেবনের অভিযোগ। উভয় ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাবির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ভয়াবহ। হেনস্তার শিকার হওয়ার শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, জাবি ক্যাম্পাসে হিম উৎসবে গিয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে ঢাকায় ফেরার গাড়ি না পেয়ে ক্যাম্পাসেই থেকে যান তাঁরা। রাতে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, টিএসসির আশপাশে বিভিন্ন জায়গায় বসে ছিলেন ভোরের অপেক্ষায়। এ সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসে তাঁদের হাতে মদের বোতল ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলে হেনস্তা করেন। জাবি শিক্ষার্থীকে ঢাবি কর্তৃপক্ষের দ্বারা পুলিশে দেওয়ার জের ধরে জাবি প্রশাসন এমনটা করেছে বলে ঢাবি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। সেখানে ঢাবির কয়েকজন শিক্ষার্থী থাকলেও কেবল জাবির শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সত্য হলে বলা যায়, একধরনের অনৈতিক ও কুরুচিপূর্ণ কাজ করে চলছে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। আটক শিক্ষার্থীদের ছবি ও সংবাদ ছাপিয়ে এবং পুলিশে দিয়ে কী উদ্ধার করতে চাইছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সেটা তারাই বলতে পারবে।

পরিহাসের বিষয়, ফেসবুকে এ নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাঁর যাঁর প্রশাসনের অন্যায় আচরণের পক্ষে দাঁড়াতে দেখছি। অথচ তাঁরা উভয়ই কিন্তু যাঁর যাঁর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনেকটাই জিম্মি। এ ধরনের ঘটনায় যেখানে তাঁদের একজোট হয়ে প্রশাসনের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করার কথা, সেখানে তাঁরা কাজিয়ায় লিপ্ত হয়েছে নিজেদের মধ্যে। নিপীড়িতদের এভাবেই ভাগ করে শাসন করা যায়।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রেষারেষি বেশ কয়েক দিন ধরেই দেখছি। ঢাবি ক্যাম্পাস এলাকায় জাবির বাস ভাঙচুর করা বা জাবি এলাকায় ঢাবি শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনাও শুনেছি। কিছুদিন আগে এক চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছেন জাবির শিক্ষার্থীরা। আমাদের সময়ও বাইরে থেকে লোকজন গিয়েছে ক্যাম্পাসে। কিন্তু এ রকম কখনোই শুনিনি। কিন্তু এখন যেতে ভয় পায়। একদিকে নিরাপত্তা টিমের হয়রানি, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের উগ্র আচরণ। প্রশ্ন হচ্ছে, কে কাকে উসকে দিচ্ছে? শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের কাছ থেকে শিখছেন, না প্রশাসন শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

হঠাৎ করেই জাবি ও ঢাবি প্রশাসন এমন আচরণ করছে কেন? মনে হচ্ছে, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যেন নরসিংদীর মেঘনার চরের মতো ঝগড়া হচ্ছে। প্রায়ই দেখি মেঘনার চরের ঝগড়াটে প্রভাবশালীরা নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে। ক্যাম্পাসের প্রক্টরিয়াল দল যেন সাক্ষাৎ লাঠিয়াল বাহিনী। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ পিঠস্থান। এখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের আরও সহনশীল হওয়ার কথা। কিন্তু ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন সবাই। এমন না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অবাধে মাদকসেবন করবেন। যা খুশি তা–ই করবেন। কিন্তু প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে যেন ভদ্রতার খেলাপ না হয়। হাসির পাত্রে পরিণত না হন তাঁরা।

শুধু জাবি–ঢাবিই নয়
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যে একধরনের মানসিক রেষারেষি দেখা যায়। এ জন্যই আমরা শুনি, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খেত। ওরা পারে না। ওরা আধুনিক না। আবার সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অনুরূপ ব্যবধানের প্রকাশ ঘটে থাকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মনে করে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঠিক তাদের মতো মেধাবী না। বেসরকারির শিক্ষার্থীরা অর্থের জোরে পড়াশোনা করছে, মেধার জোরে না। এহেন নানা ধরনের সংস্কার অনেকের মধ্যেই বিরাজমান। আগে এমন পরিস্থিতি ছিল না। এখন এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মোটের ওপর, আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি সাংস্কৃতিক মনোভাবের মধ্যে নিয়ে আসতে পারিনি।

কারণ, আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈকল্য। নিজস্ব একক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি আমাদের। দীর্ঘমেয়াদি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ শেষে স্বাধীনতার পরও আমরা নিজস্ব সংস্কৃতি বিনির্মাণে মনোযোগ দিতে পারিনি। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ও জড়িত। দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিলাম। এরপর ৪৭–এ শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে জমিদারি সামন্তদের হাত থেকে মুক্তি ও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও চূড়ান্ত রাজনৈতিক মুক্তি ঘটেনি। এর কারণেই আমাদের রাষ্ট্র ঠিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। রাষ্ট্র না হয়ে ওঠার বহিঃপ্রকাশ নাগরিকের আচরণে প্রতিফলিত হচ্ছে। রাষ্ট্র-নাগরিকের মধ্যকার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নাগরিকের অভিপ্রায়গুলোকে রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করে। যখনই রাষ্ট্র তা করতে পারবে না, তখন নাগরিক আর নাগরিক হয়ে উঠতে পারে না। রাষ্ট্রের অসহিষ্ণু আচরণ নাগরিকের আচরণের মধ্যে সংক্রমিত হয়। নানা ধরনের বিভাজন দেখা যায়, যেমন: সম্প্রদায়গত, গোত্রীয়, আঞ্চলিক ইত্যাদি।

রাষ্ট্র যেমন আচরণগত সমস্যায় নাগরিকের ওপর হস্তক্ষেপ করে, নাগরিকও অপর নাগরিকের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে স্বীকার করতে চায় না। অথচ সবারই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের অধিকার আছে। ব্যক্তি যেকোনো কিছুই গ্রহণ করতে পারে বা বাতিলও করতে পারে। ব্যক্তি আবার অপরের জন্য সমস্যাও তৈরি করতে পারে না। তাই কোনো কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সংগত না। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘অন লিবার্টি’ নামক বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছে। দেশে আইন অবশ্যই থাকবে। কিন্তু ব্যক্তি–অধিকারকে হরণ করা যাবে না। গাঁজা বা মদ্যপান গ্রহণযোগ্য না। কিন্তু জোর করে বোতল ধরিয়ে ছবি তোলাও আইনসিদ্ধ না।

রাষ্ট্রের রাষ্ট্র হয়ে না ওঠা, সর্বজনীন অধিকার মান্য না করার কারণেই এ সমস্যাগুলো দেখা যায়। এ কারণে নাগরিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্য আর কারও মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন মনোগত পার্থক্যও দেখা যায়।

চৈতন্যশীল জনসাধারণ হিসেবে নাগরিকেরা ঠিক কী পরিচয় গঠন করবে, তা নির্ভর করে আচরণের ওপর। রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়ের আচরণই সঠিক অবস্থানে নেই। তাই এ রকম হচ্ছে এবং এটাই হওয়া স্বাভাবিক। রাষ্ট্র হয়ে ওঠার জন্য কী কী গুণ দরকার, এটা আমাদের রাজনীতিবিদ বা চিন্তকেরা অনেকেই হয়তো ধারণই করেন না। তাই আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো ঠিকভাবে কাজ করছে না। জাবি ও ঢাবির এই আচরণগত সংকট ঠিক রাষ্ট্রিকতার বোধের অভাবের লক্ষণ। আমরা যে রাষ্ট্রকাঠামোর ধারণা বহন করি, তা ইউরোপীয় রাষ্ট্রকাঠামো মডেল। বলছি না যে ইউরোপের রাষ্ট্রকাঠামো মডেল কাজ করছে না। বরং বলা যায়, এই মডেল বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। আজ পর্যন্ত এটাই গ্রহণযোগ্য মডেল। কিন্তু এই মডেল আমাদের এখানে কাজ করছে না। পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের ব্যর্থতার কারণেই এটা হচ্ছে, যা ইউরোপ বা অন্যান্য স্থানে হয়নি।

জাবি ও ঢাবির এই রেষারেষির কালচার রোগের লক্ষণ কেবল, রোগ আরও গভীরে। সেটা হলো ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে স্বীকার না করা এবং সেই মর্যাদা ও অধিকারের সংরক্ষণ রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারা না ঘটা। ফলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, এলাকা থেকে এলাকায়, প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠানে এবং গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীতে রেষারেষি বাড়ছেই।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন