তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি কি সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানের মধ্যে চলমান শান্তি আলোচনা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অব্যাহত রয়েছে এবং এসব সংঘাতে দেশটির বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে। রাজধানী কাবুলে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) খোরাসান শাখার সদস্যদের সাম্প্রতিক আত্মঘাতী বোমা হামলা আফগানিস্তানের দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছে। ওই হামলায় ৬০ জনের বেশি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় ২০০ মানুষ। এই হামলার ঘটনা আরও দেখিয়েছে যে তালেবানই একমাত্র সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠী নয়, যারা কিনা সংঘাত ঘটাচ্ছে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে কোনো শান্তিচুক্তি হওয়া কি আসলেই সম্ভব?
দোহায় মার্কিন-তালেবান আলোচনাটা—যেখানে আফগান সরকার অংশ নিচ্ছে না—পূর্ববর্তী দুটি শান্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনীয়: একটি হচ্ছে প্যারিসের আলোচনা, যার ফলে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে জেনেভার আলোচনা, যার ফলে ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে জেনেভা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই চুক্তির জামিনদার হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এই দুটি চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারলেও ‘সম্মান’ নিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম করার জন্য তৈরি হয়েছিল। কিন্তু উভয় চুক্তিই তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৭৫ সাল নাগাদ সোভিয়েত সমর্থিত উত্তর ভিয়েতনামি বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামকে পরাস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রকে অবমাননা করেছিল। এবং ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আফগান ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী, মুজাহিদিনরা কাবুলে সোভিয়েত-প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটিয়েছিল। উত্তর ভিয়েতনামিরা শিগগিরই তাদের দেশকে একত্র করতে এবং শান্তি পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছিল, তবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত মুজাহিদিনরা শিগগিরই একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করে। এবং তখন পাকিস্তান উগ্রপন্থী তালেবানদের লালনপালনের মাধ্যমে তাদের আঞ্চলিক স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ নিয়েছিল। তালেবান ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে এবং সেখানে কঠোর অনুশাসন চালু করে।
তালেবানরা পালাক্রমে আল-কায়েদাকে আশ্রয় দেয়, যারা কিনা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল। এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে পরের মাসে আল-কায়েদাকে ধ্বংস ও তালেবান শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে আফগানিস্তানে অভিযান চালাতে প্ররোচিত করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী দ্রুত আল-কায়েদার নেতৃত্ব ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং তালেবানের পতন ঘটায়। তবে মার্কিন অভিযানের দুই বছরের মধ্যেই তালেবান এবং আল-কায়েদার উপাদানগুলো ফিরে আসে এবং তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন থেকেই আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়বহুল লড়াই শুরু হয়। দুই দশকের লড়াইয়ের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আফগানিস্তানে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খলিলজাদ সম্প্রতি দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর নবম দফার আলোচনার সূচনা করেছেন। এ ছাড়া তিনি আলাদাভাবে আফগান সরকার এবং বেসরকারি নেতাদের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে অসংখ্য বৈঠক করেছেন।
খলিলজাদ চারটি লক্ষ্যে মনোনিবেশ করেছেন। এগুলো হচ্ছে: বর্তমানে আফগানিস্তানে মোতায়েন সমস্ত বিদেশি সেনার প্রত্যাহারের সময়সূচি নির্ধারণ; আফগান মাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে বৈরী আচরণ শুরু হয়েছে, তা প্রতিরোধে তালেবানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়; তালেবান এবং আফগান সরকারের মধ্যে সরাসরি আলোচনা, যে সরকারকে তালেবান ‘অবৈধ’ বলে মনে করে; এবং আফগানিস্তানজুড়ে যুদ্ধবিরতি। খলিলজাদ হয়তো প্রথম দুটি লক্ষ্য নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু বাকি দুটি লক্ষ্য অর্জন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কারণ, আফগান সরকারের দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ বিভক্তির কারণে যেকোনো ক্ষমতার ভাগাভাগির ব্যবস্থায়, বিশেষত মার্কিন ও মিত্রবাহিনী ছেড়ে যাওয়ার পর তালেবান ওপরের অবস্থানে রয়েছে। তাই তারা এই সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় না–ও বসতে পারে।
ট্রাম্পের বর্তমান মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রবাহিনীর প্রত্যাহার আফগানিস্তানের স্থলভাগের পরিস্থিতির ভিত্তিতে হওয়া উচিত। অন্যথায় পরিণতি বিপর্যয়কর হবে। তাড়াহুড়ো করে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার দেশটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চাদপসরণ-পরবর্তী অবস্থায় নিয়ে যাবে। এ–জাতীয় বিপর্যয় এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের কমপক্ষে আরও এক দশক আফগানিস্তানে থাকা দরকার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
আমিন সাইকাল: অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
আরও পড়ুন
-
নাইজারে মার্কিন বাহিনীর অবস্থান থাকা ঘাঁটিতে রুশ সেনাদের প্রবেশ
-
প্রথম টি–টোয়েন্টি: তানজিদের অভিষেক, টস জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
-
সফর বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে তিন মাসেই বিদেশ গেলেন প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন
-
উপজেলা চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে বদির গুলি, থানায় অভিযোগ
-
আমেথি থেকে সরে শেষ মুহূর্তে কেন রায়বেরেলি থেকে প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল