Thank you for trying Sticky AMP!!

তিস্তায় পানির অভাবে মানুষের হাহাকার

প্রথম আলো ফাইল ছবি।

মজিদুলের বাড়ি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খালিশা-চাপানি ইউনিয়নে বাইশপুকুর গ্রামে। পেশায় জেলে। বারো মাস মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কয়েক বছর ধরে তিন-চার মাস নদীতে পানি থাকে না। তাই ওই সময়টাতে মাছ শিকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি একটি জেলে সমিতির সদস্য। ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, ‘সরকারের কাছ থাকি কোনো দিন কিছুই পাই নাই। দুই বছর আগোত সরকার কার্ড করি দেছে। যে তিন-চাইর মাস মাছ ধরা বন্ধ, সেই তিন-চাইর মাস সরকার ভাতা দেওয়ার কথা শুনছি। কই, দেইল না তো।’ এসব কথা শুনতে শুনতে সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ আবু বক্কর বললেন, ‘কিসের ভাতা দেয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড এইকনা (এতটুকু) পানিত মাছ ধইরবার দেয় না। কয়, পাঁচ শ মিটার দূরোত মাছ ধারা নাগবে। পাঁচ শ মিটার দূরোত তো পানি নাই। স্যাটে (সেখানে) কি বালুর উপর মাছ ধরমো?’ আবু বক্করের কথা সত্যি—পাঁচ শ মিটার দূরে পানি নেই।

তিস্তা নদীর ব্যারাজের উজানের অংশে সামান্য পানি আছে। ব্যারাজের ভাটিতে পানি নেই। ব্যারাজসংলগ্ন একটি বড় পুকুরের সমান জায়গায় পানি জমে আছে। সেখানে অনেকগুলো নৌকা। পাশেই একজনের কাছে জানতে চাইলাম, এতগুলো নৌকা এটুকু পানিতে কেন? একজন হেসে বললেন, মাছ জিইয়ে রাখার মতো করে নৌকাগুলোও জিইয়ে রাখা হয়েছে। নৌকা পানিতে না রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। জেলে-মাঝিদের জীবনও যেন পানিতে জিইয়ে না রাখলে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।

একটু দূরে বেশ কয়েকজন মানুষ একটি জাল মেরামত করছিলেন। এগিয়ে গেলাম তাঁদের দিকে। তাঁরা সবাই লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানি মৎস্য চাষি সমিতির সদস্য। ২২ জন সদস্য একসঙ্গে মাছ ধরেন। পাশেই একটি বাঁশের বেড়া ও ছাউনির খুব নিচু একটি চালা তৈরি করা হয়েছে। সেই চালায় তাঁরা রাত কাটান, ওই পুকুরসমান জলাধারে মাছ ধরেন।

ওই সমিতির সভাপতি রজব আলী বললেন, ‘২৪ ঘণ্টা মাছ ধরি একজনের ভাগোত দেড় শ-দুই শ টাকা আইসে। আমাদের খুব কষ্ট। এই কয় টাকা দিয়া কি সংসার চলে?’ পাশেই কদম আলী জাল ঠিক করতে করতে বলেন, ‘বউ কয়, ঘর থাকি বেইর হয়া যাও। কামাই কইবার পান না, বাড়ি থাকি বেইর হয়া যাও।’ ওই সংগঠনেরই আরেকজনের নাম আবু বক্কর। তিনি বললেন, ‘সারা জীবন তো শুধু মাছ ধরছি। অন্য কোনো কাম তো শিখি নাই।’

আবু বক্কর তাঁদের আরও কষ্টের কথা শোনালেন। যখন তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়, তখন তাঁর এক একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করে। সেই এক একর জমির দাম আশির দশকে দিয়েছিল মাত্র ১৬ হাজার টাকা। সেই টাকার চার ভাগের এক ভাগ নাকি ডিসি অফিসেই দিতে হয়েছে। এখন যে জায়গায় সেতু আছে, তা নির্মাণের সময় সেখানে সমতল ভূমি ছিল। কাজ শেষ করার পর নদীর সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার একর সমতল জমি নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, যে পরিমাণ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে, তার সবটা অর্থের বিনিময়ে অধিগ্রহণ করা হয়নি। ফলে, হাজার হাজার একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

পাশেই আরেকজন জেলে বলছিলেন, ‘ব্যারাজ দেওয়ায় ভাটিত পানির অভাব দেখা দিছে। পানির অভাবে আর চাষবাস হইতেছে না। ব্যারেজের উজানোত উপকার হইলেও ভাটিত তার চেয়ে ক্ষতি বেশি।’ একজন অভিযোগ করছিলেন, তাঁদের ভাতার কার্ড দেওয়া হলোও ভাতার কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

স্থানীয় জেলেরা বললেন, তিস্তা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের কম নয়। রজব আলী বলছিলেন, ‘পানির মৌসুমে মাছ ধরি যে টাকা ইনকাম করি, এলা সেই টাকা বসি বসি খাই। অনেকে তাও পায় না।’

তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। এই নদীর পানির ওপর কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার অনেক কিছু নির্ভর করে। সেই তাদের তিস্তা চোখের সামনে মরে যাচ্ছে। এখন বোরো মৌসুম চলছে। ব্যারাজের সব জলকপাট বন্ধ। হেঁটেই তিস্তা পার হওয়া যাচ্ছে। অথচ ভারত তিস্তার পানি বন্ধ করে নিজেরা সুবিধা নিচ্ছে।

তিস্তার মরণ দশা দেখলে যে কারও বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠবে। তিস্তা ব্যারাজের উজানে পানি আর ভাটিতে মরু দেখলে সেই কষ্ট যেন আরও বেড়ে যায়। তিস্তা ব্যারাজে আমার সঙ্গে বেড়াতে আসা চিকিৎসক মুনিরা বেগম বলছিলেন, ‘তিস্তা নদীটা দেখলে খুব কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। এক পাশে কেমন পানি, অন্য পাশে কোনো পানি নেই।’ এ বছর তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় ২৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৫ জানুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। এই জমিতেও পর্যাপ্ত পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত বছর মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। নদীর পাড়ের মাঝি-জেলে সবাই বলছিলেন, যে পানি দিয়ে যে ধান চাষ হয়, সেই পানি ছেড়ে দেওয়া থাকলে ভাটি এলাকায় অর্থমূল্যে তার চেয়ে বেশি টাকার মাছ থাকত। সেই মাছ ধরে, নৌকা চালিয়ে নদীর তীরবর্তী লাখ লাখ মানুষ সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারত।

তিস্তার পানি পাওয়ার বিষয়টি শুধু আশ্বাসেই ঝুলে আছে। বাংলাদেশ-ভারত উভয় পক্ষই শুধু ভবিষ্যতের কথা বলছে। সেই ভবিষ্যৎ যে কবে বর্তমান হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। তবে আশ্বাসের আড়ালে বাংলাদেশের নদীপারের মানুষের যে সর্বনাশ হওয়ার তা হচ্ছেই। লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। লাখ লাখ হেক্টর জমিতে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তিস্তাপারের মানুষের কষ্ট আর সংকট দূর করার জন্য তিস্তার পানির কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য দেশের সব শ্রেণির মানুষকেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com