Thank you for trying Sticky AMP!!

তোমরা যদি চীন দেখতে যাও

পশ্চিমা মিডিয়া আর চীনা তথ্য দপ্তরের বয়ান মেনে কেউ যদি চীনে পা ফেলেন, হতাশ হবেন। উভয়ের বয়ান থেকে আজকের চীন যোজন যোজন দূরে। আসল চীনকে বুঝতে হবে শুধু পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে নয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে। ভেঙে ফেলতে হবে যেকোনো পূর্ববিশ্বাসের অচলায়তন। তাহলেই দেখতে পাবেন আসল চীন। সে ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হবে ভাষা; খুব কম চীনাই আপনার সঙ্গে ম্যান্ডারিন ছাড়া ইংরেজিতে কথা বলতে পারবেন। তা-ও যে ইংরেজি তিনি বলবেন, তাকে আপনি অনায়াসে ম্যান্ডালিশ (ম্যান্ডারিন ও ইংলিশের জগাখিচুড়ি) বলতে পারেন। শরীরী ও উচ্চারিত শব্দাবলির যে যুগলবন্দি থেকে আপনি চীন সম্পর্কে জানতে চাইছেন, তার অর্থ উদ্ধারের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে, অধিকাংশ সময়ই হয়তো তা ভুল বার্তা দেবে। আর তা হলে উত্তম সমাধান হলো, চীনা ভাষা রপ্ত করা। কিন্তু তা খুব সহজ নয়। চীনা ভাষা এখনো চিত্রলিপি। তা ছাড়া অঞ্চলভেদে তার বিবিধ উচ্চারণও আয়ত্ত করা কঠিন। তবে, চীনাদের ভালোবাসার উত্তাপ আপনাকে বিমোহিত করবেই। আর চীনা রসিকতা! আহা! এমন রসিক জাতিও দুনিয়ায় আছে!

চীনে ঊনিশ-বিশ শতকজুড়ে ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমারসহ আট পশ্চিম ইউরোপীয় দস্যুদের লুণ্ঠন জারি ছিল। কিন্তু চীনে ভারতের মতো সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসন কখনো কায়েম করতে পারেনি তারা। ভয় দেখিয়ে, প্রতারণার ফাঁদ পেতে, নানা রকম ঘুষ দিয়ে দুর্নীতিবাজ সম্রাটদের গদিতে রেখেই ইউরোপীয় লুটেরা দল চীন থেকে সম্পদ লুট করেছে। রেললাইন বসিয়ে, খনি লুণ্ঠন করেও তারা দেশটাকে ফতুর করে। বিপরীতে চীন হয়ে ওঠে ইউরোপীয় পণ্যের অবাধ বাজার; পরিণত হয় দ্বিমুখী লুণ্ঠনের মৃগয়া ক্ষেত্র। প্রায় ২০০ বছর ধরে এমন আধা-ঔপনিবেশিক অন্ধকার যুগ কেটেছে চীনের। ব্রিটিশ-শাসিত ভারত থেকে জাহাজ বোঝাই করে আফিম নিয়ে চীনাদের খাইয়ে তাদের বুঁদ করে রেখেছিল ইউরোপ। অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল চীন। আফিমে মাতাল চীনারা ভুলে গিয়েছিল ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকেই। বিশ্বযুদ্ধের আগুনে পুড়েছে, জাপানি আগ্রাসনে বৃহৎ চীনের বিস্তৃত ভূভাগজুড়ে চলেছে নজিরবিহীন তাণ্ডব, খুন, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে জাপানিরা। সে নারকীয় বীভৎসতার দলিল হয়ে আছে আইরিশ চ্যাঙের লেখা ‘দ্য রেপ অব নানকিং’ নামক অমর গ্রন্থটি। গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়েছে চীন। বিশ শতকের সূচনা পর্যন্ত এমন বৈরী পরিবেশে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসা প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি চীন আবার কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, তা যেন ছিল স্বপ্নের অতীত। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে চীনা হিকমতি জনগণ। প্রথমে জাতীয়তাবাদী সান ইয়াৎ সেন (১৮৬৬-১৯২৫) ও পরে কমিউনিস্ট মাও সে তুংয়ের (১৮৯৩-১৯৭৬) নেতৃত্বে। সে ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি বিস্ময়ে ভরা।

ইতিহাসের বিবর্ণ পাতাগুলো আমরা আপাতত খুলছি না। সাত বাঙালির চীন দর্শনের প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে আলাপ জমবে ভালোই। ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা বোর্ডিং পাস নিই ১৮ মের শেষ প্রহরে; কিন্তু যখন ইমিগ্রেশন পার হই, তখন ঘড়িতে মধ্যরাতে তারিখ ১৯ মের শুরু। চায়না সাউদার্নের বিমানপোতটিও ঢাকার মাটি ছেড়ে আকাশে ভাসল ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় মধ্যরাত ১২:৫০ মিনিটে। তিন ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের এক সুখকর উড়াল শেষে যখন চায়না সাউদার্ন বিমানটি গুয়ানজু বাইয়ুন বিমানবন্দরে শান্তির বার্তাবহ কপোতের মতো আলতোভাবে নামল, আমরা বুঝতেই পারিনি বিমানপোত মাটি ছুঁয়েছে। পাইলটদেরÿপ্রশংসা করতেই হয়। বাংলাদেশ থেকে ঘড়িতে চীন দুই ঘণ্টা এগিয়ে। স্থানীয় সময় তখন সকাল ৬:২৫ মিনিট। সকালের সোনাঝরা রোদ্দুর তখন গুয়াংজুতে খেলা করছে। চোখ জুড়িয়ে গেল।

ইউরোপ প্রাচ্যের বহু শহর-বন্দরের নাম বদলে দিয়েছিল। ‘এশিয়া’ বলতে তারা বোঝায় ‘আমরা’ নই, ‘ওরা’। গুয়াংজুর কপালেও নাম বদলের কলঙ্ক লেপে দিয়েছিল ইউরোপ। প্রাচীন এই বন্দর নগরী গুয়াংজু ইউরোপে ক্যান্টন নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পণ্য কেনাবেচার প্রধান প্রধান ঠিকানার নিকটতমটি কুনমিং, অপরটি হলো গুয়াংজু। আর শিল্পনগরী সাংহাই তো আছেই। কিন্তু পার্ল নদীর তীরে এ সুন্দর ও মনোরম গুয়াংজু শহরে আমাদের বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার সময় নেই। চেয়ারম্যান মাওয়ের জন্মভূমি শাওশান যাওয়ার উদ্দেশে আমরা হুনান প্রদেশের রাজধানী চ্যাংশা যাব। অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে অপেক্ষা করছে আমাদের চ্যাংশা যাওয়ার বিমান। সেখানে রাত কাটিয়ে মাইক্রোযোগে পরদিন সকালে শাওশান যেতে হবে।

বিশাল বিমানবন্দর এই গুয়াংজু। চীনে তার অবস্থান তৃতীয়। প্রতি তিন মিনিটে একটি করে বিমান আকাশে উড়ছে, নামছে। ওয়াশিংটনে রোনাল্ড রিগান বিমানবন্দরে অবশ্য প্রতি মিনিটে একটি বিমান ওঠা-নামা করে। সুন্দরী চীনা ইমিগ্রেশন অফিসারদের সহৃদয় ও উষ্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ হতে হয়। গুয়াংজু ইমিগ্রেশনে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন তারা। ওয়ারশো, স্টকহোম, নিউইয়র্ক, দিল্লি, কুয়ালালামপুর, কলকাতা বা ঢাকায় এমন আন্তরিকতার দেখা পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। সাধারণত ইমিগ্রেশন অফিসার হন গোমড়ামুখো। পর্যটকদের সন্দেহের চোখে দেখাই নাকি রেওয়াজ। কিন্তু চীনা ইমিগ্রেশন অফিসারদের মুখের হাসি যেন ফুরায়ই না। ব্যাংককের লাস্যময়ী রমণীদের হাসির সঙ্গে তা তুলনীয়। প্রাচ্যের অভিবাদন কার না মন কাড়ে? সামান্য নত হয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিমা সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো। কোথাও পুলিশের আধিক্য নেই, বাড়াবাড়ি নেই। বুকে ‘সিকিউরিটি’ তকমা এটে কিছু পুলিশ নজর রাখছেন, কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন; নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি না করতে পারে। কিন্তু কাঁধে কোন বন্দুক নেই। সর্বত্র ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার নজরদারি। যথেচ্ছ ঘোরাঘুরিতেও কোনো বাধা নেই। মোবাইলে ছবি তোলায় কোনো আপত্তি জানালেন না কেউ।

সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়। পাসপোর্টের পরিচয় শনাক্তের জন্য বায়োমেট্রিক প্রযুক্তিতে দশ আঙুলের ছাপ নিয়ে যন্ত্রে লেখা ভেসে উঠল, ‘আপনাকে স্বাগতম’। এমনকি, বায়োমেট্রিক পদ্ধতি কীভাবে করাতে হবে, সেটিও বলা হলো বাংলায়! হয়তো বাংলাদেশি পাসপোর্ট শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষার যান্ত্রিক ব্যবহার শুরু। কাগজপত্র দেখে দুই মিনিটেই সিলমোহর লাগিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে দিলেন তরুণী অফিসার। সেখান থেকে ব্যাগেজ ক্লেইমে যেতেই মিলে গেল আমাদের ব্যাগেজ। এক মিনিটও অপেক্ষা করতে হল না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দর। হাঁটার সুবিধার জন্য মাঝেমধ্যেই রয়েছে এলিভেটর। চোখ জুড়ানো ইন্টিরিয়র ডেকোরেশন। ইমিগ্রেশন আর কাস্টসমের ঝামেলা চুকিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক টার্মিনাল থেকে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে গেলাম দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে। আমাদের দলে চারজন ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের জন্য হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা ছিল, যদিও আমরা কখনো সে সুবিধা গ্রহণ করিনি।

চ্যাংশা যাওয়ার বিমানে ওঠার পূর্বে নিরাপত্তাব্যবস্থা খুবই কড়া। তবে সেখানেও নিরাপত্তাকর্মীদের সহাস্য বিনয়ী ব্যবহারে মুগ্ধ আমরা। চ্যাংশা বিমানবন্দরে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এক স্মার্ট তরুণ মাইক। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক। এই প্রথম তিনি কোনো বাংলাদেশি পর্যটক দলের গাইড হিসেবে কাজ করবেন। তার মধ্যে তাই উত্তেজনার শেষ নেই। হোটেলে যাওয়ার পথে প্রথমেই তিনি প্রাচীন চীনা সভ্যতা থেকে আধুনিক চীনের এক মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিলেন আমাদের। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি চেয়ারম্যান মাওয়ের নাম উচ্চারণ করলেন। তিনিই চীনা জনগণের মুক্তিদাতা, বললেন মাইক। ❒

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান