Thank you for trying Sticky AMP!!

দিল্লির ভোট: ভারতীয় গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা

অরবিন্দ কেজরিওয়াল

একটা চালু রসিকতা ছিল আমাদের ছোট বেলায়। পাকিস্তান-ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে। তখন ভারতীয় ক্রিকেটে স্পিনারদের রমরমা। বেদী, প্রসন্ন, চন্দ্রশেখরের দাপটে থরহরি অবস্থা বিভিন্ন দেশের ব্যাটসম্যানদের। এহেন ভারত সেবার পাকিস্তানে খেলতে গেছে। যথারীতি বেদী-চন্দ্রশেখরের স্পিনের ভেলকিতে গেল গেল রব উঠেছে পাক শিবিরে। তাদের একমাত্র ভরসা তখন আম্পায়াররা। নিশ্চিত আউটও আম্পায়ারের সৌজন্যে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। একদিন চন্দ্রশেখরের বলে নামী এক ব্যাটসম্যানের উইকেট ছিটকে গেল ওভারের শুরুতেই। আওয়াজ উঠল—হাউজ দ্যাট। আম্পায়ার ধীরে ধীরে আঙুল তুলে আউটের নির্দেশ দিতেই চন্দ্রশেখর বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, উনি কি প্যাভিলিয়নে যাচ্ছেন! ঈষৎ বিস্মিত আম্পায়ার সামান্য রেগে জবাব দিলেন 'আপনি নিজেই উইকেট ছিটকে দিয়ে প্রশ্ন করছেন। মানে কী! চন্দ্রশেখর বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘উইকেট ছিটকেছি এটা ঠিক। কিন্তু আউট হয়েছেন কী!’

কারচুপি-দুর্নীতির এই ক্রিকেটীয় আখ্যানটি মনে এল দিল্লি বিধানসভায় সবে শেষ হওয়া নির্বাচনের ফল কী হবে, তা নিয়ে লিখতে বসে। এমনিতে ভোট হয়ে যাওয়ার পরেই ভারতের সব মিডিয়াই স্পষ্ট করে ভোটফেরত সমীক্ষায় জানিয়ে দিয়েছে যে এবারও নিশ্চিত দিল্লি ভোটে বিজেপিকে হারিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে আম আদমি পার্টি—সংক্ষেপে আপ।

কিন্তু ওই যে জয়-পরাজয়ের মাঝখানে ধূসর অঞ্চল পাকিস্তানের আম্পায়ারের মতো আমাদের ইভিএম মেশিন, সেও যেকোনো জেতা ম্যাচকেও যখন-তখন হারিয়ে দিতে পারে খলনায়কোচিত দক্ষতায়। ফলে যে যা-ই পূর্বাভাস দিক, আমি কিন্তু নিশ্চিত নই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জয় নিয়ে। ভোট নিয়ে দিল্লি থেকে এখনো যেটুকু যা খবর পেয়েছি, তাতে অবশ্যই সব সমীক্ষার সঙ্গে আমিও মনে করি এবারও আপ জিতছে। কিন্তু জিতছেই বলতে পারছি না, যেহেতু তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম বিজেপি। আর কে না জানে, সব দেশেই মানি, মেশিন ও মাসল—এ তিন পাওয়ার আজকের ভোটে বাজিমাত করার গুরুত্বপূর্ণ তিন শক্তি, তাতে এই মুহূর্তে বিজেপির ধারেকাছেও কেউ নেই।

আপাতসাধারণ এক বিধানসভা নির্বাচন এবার ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা নিয়েছে। বস্তুত এটা আর এখন শুধু দলের সঙ্গে দলের ভোটযুদ্ধে দাঁড়িয়ে নেই।
এ নির্বাচনে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে যা আগে কখনো বিধানসভা নির্বাচনে ওঠেনি। প্রশ্ন উঠে গেছে দেশের সংসদীয় কাঠামো নিয়েই। দেশ সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে, না একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হবে, তার কিছুটা আভাষ পাওয়া যেতে পারে দিল্লি নির্বাচনে। এবারের মতো আগে কখনো নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সরকারি দল এমন খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। দিল্লি সম্পর্কে এক-আধটু খোঁজ খবর রাখেন যাঁরা, তাঁরা একবাক্যে মানবেন যে গত পাঁচ বছরে প্রভূত কাজ করেছে কেজরিওয়াল সরকার। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোলনলচে বদলে দিয়েছে আপ সরকার। স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি চোখে পড়ার মতো। আপনি দিল্লির যেকোনো ঝুগ্গিবস্তিতে যান, গরিব মানুষ কেজরিওয়াল সরকারের সুখ্যাতি করবেই। পুরান দিল্লির মুসলিম মহল্লায় এখন শুধুই আপের পতাকা, যা আগে ছিল কংগ্রেসের ঘাঁটি, সেখানে এখন আম আদমি পার্টির দুর্গ।

এবারের ভোটে কেজরিওয়াল যেখানে উন্নয়ন নিয়ে সরব, ভারতীয় জনতা পার্টির একমাত্র অস্ত্র সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশের স্বাধীনতার পর এমন খোলাখুলি একটি সম্প্রদায়ের ওপর শাসক দলের এমন ঘৃণার প্রকাশ আগে কখনো ভারত দেখেনি। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপির ছোট নেতা থেকে বড়—সবাই নিজের দেশের একাংশের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়াইয়ে নেমেছেন, তা এককথায় অভূতপূর্ব বিষয়।

সত্যি কথা বলতে কি, বিজেপি দিল্লি ভোটে হারলে নিঃসন্দেহে চাপে পড়বে। ইতিমধ্যেই ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়েছে। রাজধানীর নির্বাচনে হারলে তাদের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে বাধ্য। তাই মনে হয় না বিজেপি সহজে হার মানবে। জনতার রায় নীরবে মেনে নেওয়ার মতো নিরীহ বিজেপি নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা তার কোনো কালে ছিল, এমন সার্টিফিকেট তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুও দেবে না। এবারের নির্বাচনে কেজরিওয়ালকে যদি হারানো হয়, তাহলে ভারতের বহু বিজ্ঞাপিত গণতন্ত্র চরমভাবে বিপর্যস্ত হবে। ফেডারেল কাঠামোর বদলে একটি দলের শাসন কায়েম হওয়ার বিষয়টি তখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র।

তাই কেজরিওয়ালের জয় নিয়ে আশাবাদী হলেও ১০০ শতাংশ নিশ্চিত নই। কথায় আছে না, আঁচালে বিশ্বাস নেই। মজার বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান জুজু দেখিয়ে বিজেপি ভোটে বাজিমাত করতে চাইছে। এনআরসি-বিরোধী উত্তাল গণ-আন্দোলনকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছে, তাদের সঙ্গে তুলনা করতে হচ্ছে পাকিস্তানের ‘নিরপেক্ষ’ আম্পায়ারদের। যারা নিজেদের স্বার্থে যাবতীয় পদ্ধতি নিতে এক মুহূর্ত দেরি করে না। দুঃখ এটাই, তাদের মতোই আমাদের শাসকেরাও প্রয়োজনে যাবতীয় সততা বিসর্জন দিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করেন না। জীবন, ক্রিকেট, নির্বাচন—লক্ষ্য একটাই। ছলেবলে কৌশলে স্রেফ জয় হাসিল করা।

লেখক: ভারতের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।