Thank you for trying Sticky AMP!!

দুঃখ রইল, বেশি রইল শূন্যতা

ব্যারিস্টার রফিক–উল হক (জন্ম: ২ নভেম্বর ১৯৩৫ —মৃত্যু ২৪ অক্টোবর ২০২০)

ছাত্রজীবন থেকে তিনজন আইনজীবীর নাম শুনতাম। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ আর ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। এস আর পাল, আমিনুল হক, টি এইচ খান আর খন্দকার মাহবুব উদ্দিনের মতো আইনজীবীরাও তখন খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু নাম বেশি শুনতাম এ তিনজনের।

এঁদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন অনন্য ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ইশতিয়াক আহমেদের নামও উচ্চারিত হতো একসঙ্গে। তুলনায় রফিক-উল হক হাউসহোল্ড নেম হয়ে ওঠেন কিছুটা পরে, ‘ওয়ান-ইলেভেনে’র সময়।

২০০৭-০৮-এর সে সময়ে কারাবন্দী দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পক্ষে দাঁড়াতে সাহস হয়নি বড় আইনজীবীদের। রফিক-উল হক একাই তখন দুই নেত্রীর আইনজীবী হয়ে বহু মানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে টক শোতে সাহসী বক্তব্য দিয়ে তিনি জনমানুষের কাছেও পরিচিত হয়ে ওঠেন।

স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ‘ওয়ান ইলেভেনে’র সময় থেকে। তিনি টেলিভিশনে আমার বক্তব্য শুনে বা পত্রিকার লেখা পড়ে ফোন করতেন। এত প্রশংসা করতেন যে অবাক হতাম। একদিন তিনি বললেন, যা তুমি বলো, বুড়িটার তো বয়স থাকলে তোমার সঙ্গে পালিয়ে যেত। বলে স্যার মধুরভাবে হাসলেন। ‘বুড়ি’টা কে বুঝতে আমার সময় লাগল। সংকোচে কাঁচমাচু হয়ে গেলাম। পরে স্যারের বাসায় তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চোখ নাচিয়ে হাসলেন, ‘বলেছিলাম না তোমাকে বুড়িটার কথা!’

স্যার পরিচিত ছিলেন বদরাগী মানুষ হিসেবে। অথচ কোনো দিন আমি নিজে তাঁকে রাগতে দেখিনি। বরং রসিকতা করে এমনভাবে হাসতেন, মনে হতো মনে মনে শিশু তিনি। বেশি পরিচিত ছিলেন তাঁর পেশাদার মনোভাবের জন্য। ড. কামালের মতো তিনি শুধু বিনে পয়সায় সমাজের অসহায় ও নির্যাতিত মানুষকে আইনি সেবা খুব একটা দিতেন না, আইনি পেশার লড়াইয়ে জেতার জন্য তিনি মরিয়া পদক্ষেপও নিতেন। কিন্তু এ পেশায় তাঁর কোটি কোটি টাকার উপার্জন তিনি অকাতরে ব্যয় করতেন দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে। বারডেম, আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল আর আদ-দ্বীন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজে অকাতরে দান করেছেন। নিজে স্কুল, এতিমখানাসহ দাতব্য প্রতিষ্ঠান করেছেন। যেকোনো গরিব আর অসহায় মানুষের জন্য নিজের টাকাপয়সা অবাধে দান করেছেন।

একটা ঘটনা বলি। আমার এক দরিদ্র ছাত্রীর ক্যানসার হলো একবার। বাঁচতে হলে তাকে অবিলম্বে বিদেশে নিতে হবে চিকিৎসার জন্য। তার বাবা একদিন মেয়েসহ আমার রুমে এলেন। ‘আমার মেয়েকে বাঁচান’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি ব্যাকুল হয়ে তার কথা প্রথম আলোতে লিখলাম। অল্প কিছু টাকা জমা হলো তাঁদের অ্যাকাউন্টে। বড়লোক ধরনের লোকজনের কাছে ফোন করলাম। সবাই শুধু আশ্বাস দেন বা পরে যোগাযোগ করবেন বলে জানান। অল্প দিন হলো পরিচয় হয়েছে স্যারের সঙ্গে। মরিয়া হয়ে তাঁকেই ফোন করলাম। অর্ধেক শুনে তিনি বললেন, ‘কত পাঠাব, বলো।’ আমি সাহস করে বললাম, হাজার বিশেক পাঠানো যাবে, স্যার? তিনি হাসলেন। বিকেলে আমার বিভাগের পিয়ন কুদ্দুস ফোন করে বলল, ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন তিনি।

তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে ততটা আগ্রহী ছিলেন না। তবু আমাদের কথা শুনে ২০১১ সালের নভেম্বরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য নাগরিক আন্দোলন নামে একটি নতুন সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব নেন তিনি। জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রতিষ্ঠানটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সুশীল সমাজের একটি সম্মিলিত সংগঠন আমরা করছি। এর মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক দল ও সরকারের ভুল ধরিয়ে দেব, গণতন্ত্র বিকাশে তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা করব।’ পরে এ সংগঠনের দু-একজন সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। আরও পরে তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হলে এবং শরীর খুব খারাপ হয়ে গেলে তিনি ধীরে ধীরে আইন পেশা ও গণমাধ্যম থেকে পুরোপুরি দূরে সরে আসেন।

কয়েক বছর আগে স্যার ফোন করে তাঁর একটি পরিচিত প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যেতে বলেন। স্যারের সঙ্গে কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিই। আসা-যাওয়ার পথে বহু বিষয়ে অনেক কিছু বলেন তিনি। স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিষয়গুলোয় স্যারের অবর্তমানে কিছু লেখা ঠিক হবে না আমার। তবে এটুকু বলে রাখি, জীবদ্দশায় আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, এটি দেখে যাওয়ার প্রচণ্ড তাগিদ তাঁর মধ্যে ছিল। বারবার তিনি পরম মমতায় বলেছেন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁর ভালোবাসার কথা। কথা। বলেছেন দেশে গনতন্ত্র আর সুশাসন দেখার আকাঙ্খার কথা।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে একটি আলোচিত বিষয় ছিল সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। তিনি গণমাধ্যমে বললেন, এ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা হলে সমস্যা নেই। স্যারের বক্তব্য, এ নিয়ে বিতর্ক করলে সমস্যা আরও বাড়বে। আমি স্যারের সঙ্গে দ্বিমত করে প্রথম আলোতে লিখলাম। স্যারের একটু সমালোচনাও করলাম। পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বললেন, ‘তোমার লেখাটা ভালো ছিল।’

স্যারের সঙ্গে আর বোধ হয় দেখা হয়নি আমার। তিনি পরলোকগমন করেছেন গতকাল। শেষ দিকে খুব অসুস্থ ছিলেন। কেন তখন তাঁকে দেখতে যাইনি, সারা জীবন বিপন্ন বিস্ময় হয়ে থাকবে তা।

স্যারের জানাজা পড়েছি গতকাল। তিনি চলে গেছেন ৮৫ বছরে। এ বয়সে কেউ মারা গেলে অভিযোগ জানানোর কিছু নেই। হয়তো দুঃখ পাওয়ারও কিছু নেই। তবু বইভর্তি ঘরে ক্ষীণদেহী এ মানুষটার নিমগ্নতার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, বহু দুর্যোগকালে তাঁর কথা শুনত মানুষ মন দিয়ে। মনে পড়ে, হাসপাতাল নিয়ে স্মৃতিচারণার সময় তাঁর সজল চোখের কথা।

ভালো থাকবেন, স্যার। আমার বিশ্বাস, এমন মানুষরা নিশ্চয়ই ভালো থাকেন অনন্ত ভুবনে!

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও লেখক।