Thank you for trying Sticky AMP!!

দুর্গত মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে

পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ

আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন নানা আর্থিক প্রতিকূলতায় দুঃখকষ্টময়। প্রাণিকুলের যে আদিতম চাহিদা, সেই খাদ্যের নিরাপত্তা এখনো শতভাগ সুনিশ্চিত করা যায়নি। যদিও শুধুই খাদ্যাভাবে আজকাল আর কেউ মারা যায় না, যদিও বলা হয় যে আমরা ক্ষুধা জয় করেছি, তবু এখনো এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রধান দুশ্চিন্তা খাদ্য নিয়েই। এবং তা দুর্যোগমুক্ত, স্বাভাবিক সময়েই। তাই যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে, তখন আমরা দেখতে পাই, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার বোধ কত ভঙ্গুর। বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবন, বিশেষত তাঁদের শিশুদের জীবন কতটা বিপন্ন।

গত এপ্রিল থেকে আমরা বড় আকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি। প্রথমে হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা অকালবন্যায় ব্যাপক ফসলহানির শিকার হলেন। হাওরের ধান ও মাছ হারিয়ে লাখ লাখ পরিবারের জীবনে নেমে এল ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি দুঃখকষ্ট। তারপর রাঙামাটিসহ তিনটি পার্বত্য জেলায় অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধসে মারা গেলেন দেড় শতাধিক মানুষ; শত শত পরিবারের ঘরবাড়ি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নষ্ট হয়ে গেল। এবং সর্বশেষ দেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শুরু হলো আষাঢ়ের বন্যা। পানিবন্দী হয়ে পড়লেন লাখ লাখ মানুষ।

যদিও শোনা যাচ্ছে যে কোনো কোনো এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, তবু আরও বড় বন্যার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ, উত্তরাঞ্চলের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাবিত হতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের কোনো কোনো জেলা। তা ছাড়া, আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে, এ বছর বন্যার আশঙ্কা আছে। গত রোববার রাজধানীতে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘আমরা আরেকটি বন্যার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।’

হাওরের ফসলহানি, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া এবং বাজারে চালের দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়া—এই পরিস্থিতিতে বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করলে কয়েক কোটি দরিদ্র মানুষের জীবনের চলমান দুঃখকষ্ট সংকটময় রূপ ধারণ করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, কাউকে খাদ্যসংকটে পড়তে হবে না, কারণ সরকারি, বেসরকারি, চালকল মালিক ও কৃষক পর্যায়ে সারা দেশে এক কোটি টনেরও বেশি খাদ্যশস্য মজুত আছে। তা ছাড়া, খাদ্যের মজুত আরও শক্তিশালী করতে বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। বন্যার কারণে যাতে কাউকে খাদ্যসংকটে পড়তে না হয়, সে জন্য সরকার এটা করছে।

অর্থাৎ, বোঝা যায় যে দেশের দুর্যোগময় পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার সচেতন আছে এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোর কোনো মানুষ যেন খাদ্যের অভাবে কষ্ট না পায়—সরকারের এই শুভ অভিপ্রায় সবার জন্যই স্বস্তিদায়ক। তবে এটা যথেষ্ট নয়। এখন খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার, দুর্গত মানুষগুলোর সত্যিকারের অবস্থা কী। সরকারিভাবে যে ত্রাণসহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় মোটেও পর্যাপ্ত নয়—এমন খবর সংবাদমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত হয়েছে।

একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে: হাওরে ফসলহানির কারণে শুধু সুনামগঞ্জ জেলাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৯৯০টি পরিবার। কিন্তু ত্রাণসহায়তার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার পরিবারকে। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি পরিবারই সরকারি ত্রাণসহায়তার বাইরে রয়ে গেছে। তাহলে এই মানুষগুলোর চলছে কীভাবে? তাঁদের ঘরে ঘরে কি ইতিমধ্যেই খাদ্যাভাব দেখা দেয়নি? স্থানীয় প্রশাসনগুলো কি খোঁজ নিয়ে দেখেছে, ওই সব পরিবারের সদস্যরা অর্ধাহারে-অনাহারে রয়েছেন কি না?

ত্রাণসহায়তার অপর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ জেলার এই দৃষ্টান্ত সব দুর্গত এলাকার জন্যই কমবেশি প্রযোজ্য। কিন্তু শুধু অপর্যাপ্ততা নয়, ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থাপনা নিয়েও গুরুতর ভাবনার বিষয় আছে। যেসব ভাগ্যবান পরিবার ত্রাণসহায়তার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে, তারা সবাই কি তা ঠিকমতো পাচ্ছে? সংবাদমাধ্যমে এমন অভিযোগ অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে যে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর অনেক মানুষের কাছে ত্রাণসহায়তা পৌঁছায়নি। এমন অভিযোগও রয়েছে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানদের আত্মীয়স্বজন ও তাঁদের দলীয় সমর্থকদের অনেকের দ্বারা দুর্গত মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কোথাও কোথাও সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁদের বলা হয়েছে, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হচ্ছে এ রকম অভিযোগ পেলে তাঁরা তদন্ত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু প্রশাসনের বক্তব্য এ রকম দায়সারা গোছের হওয়া উচিত নয়, তাঁদের নিজেদের উদ্যোগেই খতিয়ে দেখা উচিত ত্রাণ বিতরণে কোথাও কোনো অনিয়ম হচ্ছে না, দুর্গত মানুষগুলোকে তাদের যৎসামান্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কি না।

আমাদের দেশে ত্রাণসহায়তা বিতরণ-ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও জবাবদিহির অভাব একটা পুরোনো ব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। এপ্রিল মাসে হাওরে ফসলহানির সময় সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে গিয়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এটাও লক্ষ করেছি যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ বা ত্রাণসহায়তা ঠিকমতো পাওয়ার ব্যাপারে একধরনের সন্দেহ আছে। সুনামগঞ্জের রাস্তায়, গলিতে, বাজারে লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, সরকারি ত্রাণ আসবে বলে দুর্নীতিবাজেরা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য গোঁফে তা দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকম ধারণা কোনো বাস্তব ভিত্তি ছাড়াই গড়ে ওঠেনি।

অর্থাৎ, দুর্গত মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘব করা, কিংবা ন্যূনতম মাত্রায় রাখার চেষ্টা করার ক্ষেত্রে প্রধান দুটো সীমাবদ্ধতা হলো ত্রাণসহায়তার অপর্যাপ্ততা এবং যেটুকু ত্রাণের ব্যবস্থা করা গেছে তার সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও ন্যায্য বিতরণ নিশ্চিত করা। সরকার যদি আন্তরিকভাবেই অনুভব করে যে দুর্গত মানুষকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা একটা মৌলিক সাংবিধানিক দায়িত্ব, তাহলে এই দুটি দিকে নজর দেওয়া উচিত।

সুনামগঞ্জের দৃষ্টান্ত থেকে অনুমান করা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে ত্রাণসহায়তার আওতায় আনতে হলে এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে দ্বিগুণেরও বেশি। সেই সামর্থ্য সরকারের আছে কি না, তা নিরূপণ করা দরকার। সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আর্থিক অবস্থা এক নয়। যাঁদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ, সহায়তা ছাড়া যাঁদের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন, তাঁদের অবশ্যই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের আর্থিক সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। তাই বেসরকারি খাত বা সমাজের সামর্থ্যবান মানুষেরও এগিয়ে আসা উচিত। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গত মানুষের দিকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে একটা সামাজিক ঐতিহ্য ছিল, তা কী করে হারিয়ে গেল, এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার।

আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। কিন্তু এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা যে এখনো কত অসম্পূর্ণ, তা দুর্যোগের সময় অতি মর্মান্তিকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের এ দেশে দুর্যোগের মাত্রা নিরূপণ করা হয় লাশের সংখ্যার হিসাবে। মানুষের মৃত্যু না হলে ধরে নেওয়া হয়, দুর্যোগ গুরুতর নয়। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলো থেকে এখনো মৃত্যুর খবর আসেনি।

কিন্তু মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে, এভাবে শুধু টিকে থাকার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিগুলো কী হতে পারে, তা ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার, খাদ্য বলতে যখন শুধুই ভাত বোঝাই, এবং দুবেলা সেই ভাতটুকুরও পর্যাপ্ত সংস্থান হয় না, তখন মানুষের জীবন কিসের জীবনের সঙ্গে তুলনীয় হয়। বন্যা দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগ; দিনের পর দিন শুধু আধপেটা নুন-ভাত খেয়ে যে নারী ও শিশুদের প্রাণ রক্ষা করতে হবে, মাস দুই-তিনেক এভাবে কাটানোর পর তাদের শরীরের পুষ্টির অবস্থা কী দাঁড়াবে?

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির ত্রিপুরাপল্লির শিশুদের কথা মনে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রকট অপুষ্টিতে ভোগার ফলে তাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা এমন মারাত্মকভাবে কমে গেছে যে রোগ নির্ণয়ের আগেই তার ধকল সইতে না পেরে এক সপ্তাহের মধ্যে নয়টি শিশু মারা গেছে। ফসলহানির শিকার হাওরাঞ্চলসহ বন্যাদুর্গত সব এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য ত্রিপুরাপাড়ার শিশুদের মতোই সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারের ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমে এই শিশুদের প্রকট অপুষ্টি থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া উচিত। বিশেষত, পাঁচ বছরের কম বয়সী অপুষ্ট শিশুদের জন্য, যাদের অপুষ্টির মাত্রা আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের শিশুদের মতো মারাত্মক।

মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।