Thank you for trying Sticky AMP!!

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় এখনই

তলস্তয়ের ‘থ্রি কোশ্চেনস’ বা ‘তিনটি প্রশ্ন’ গল্পে তিনটা প্রশ্ন ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী? উত্তর হলো: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তিনি, যিনি আপনার সামনে আছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মানুষের উপকার করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো ‘এখন’।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ভাগ্যনিয়ন্তাদের এই কথা তিনটি আমলে নিতে বলি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো মানুষ। আপনার সামনে যে ১৭ কোটি মানুষ আছে, তারা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এই ১৭ কোটি মানুষের উপকার করা। এবং তা করতে হবে এখনই।

দুর্নীতি আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে। আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে ফ্লাইওভার বানানোর পর বুঝি, এটা না বানালেও চলত। চার-চারটা সরকারের আমলে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করে যশোরে গ্যাস সঞ্চালন স্টেশন বানানো হয়েছে, ২০১৬ সালে প্রকল্প শেষ হয়েছে। সেটা এখন পরিত্যক্ত প্রকল্প। কারণ, ওই এলাকায় সরবরাহ করার মতো কোনো গ্যাসই নেই। ২০০৬ থেকে ২০১৫—এই ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের দুই বছরের বাজেটের সমান।

এই সব খবরের সঙ্গে যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দ ও চাঁদাবাজির খবরগুলো মিলিয়ে পড়ি, যদি ছাত্রলীগ নেতাদের পদ হারানোর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিই, যদি যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত অভিযোগগুলো ভাবি, মনটা দুমড়েমুচড়ে যায়। আর কোনো আশা কি এই দেশের সামনে নেই?

আকবর আলি খান পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের পুস্তক থেকে আলোচনা করছেন। দুর্নীতির চার কুফলের কথা সেখানে বলা হয়েছে: ১. দুর্নীতিতে রাজস্ব আয় কমে। আর ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। ফলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ২. দুর্নীতিপ্রবণ সমাজে পরিবেশের দ্রুত অবনতি ঘটে। ৩. দুর্নীতি সমাজে বৈষম্য বাড়ায়, গরিব আরও গরিব হতে থাকে। ৪. দুর্নীতি দেশে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।

এর সঙ্গে যদি দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার মহামারিকে যোগ করি, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সমস্ত দুর্ভাবনা সাঁড়াশির মতো করে চেপে ধরে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

দুর্নীতি সারা পৃথিবীতে সব সময়েই ছিল। দুই হাজার বছর আগে চাণক্য লিখেছিলেন, সরকারি কর্মচারীরা দুইভাবে বড়লোক হয়, তারা সরকারকে প্রতারণা করে, আর প্রজাদের ওপরে অত্যাচার করে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দুর্নীতির বিবরণ আছে; আছে মলুয়ার পালায়। তবে ইংরেজ আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। প্রধানত উপনিবেশ নিজেই সব দুর্নীতির সেরা দুর্নীতি। সাদারা কালো মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি করেছে, তাদের আজীবন ক্রীতদাস বানিয়ে নিপীড়ন করেছে। বলা হয়ে থাকে, ব্রিটিশরা বিলাতি ব্যবস্থা এই দেশে প্রবর্তন করতে গিয়ে একটা মধ্যবর্তী শ্রেণি গড়ে তোলে, যারা ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমাদের ১৯৪০-এর দশকে নেতাদের দুর্নীতির বর্ণনা পাই। তিনি লিখেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল না যে এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি।’ তখন ফ্লোর ক্রস করা যেত বলে এমএলএ কেনাবেচা হতো। এটা পাকিস্তান আমলেও হয়েছিল ব্যাপকভাবে।

অতীতে যা হওয়ার হয়েছে। ‘থ্রি কোশ্চেনস’ গল্পের মতো বলব, এখনই কাজ শুরু করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা সার্বিক সংগ্রাম শুরু করতে হবে। আমাদের কৃষকেরা পরিশ্রমী, তাঁদের সৃজনশীলতার তুলনা নেই। তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অহোরাত্রি পরিশ্রম করেন, নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা গ্রহণ করে অতি অল্প পরিমাণ ভূমি থেকে কোটি কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগাচ্ছেন। ছোট উদ্যোক্তারা সারা দেশে নানা বিচিত্র উদ্যোগে আয়োজনে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করার প্রয়াস পাচ্ছেন। অভিবাসী শ্রমিকেরা অমানুষিক পরিশ্রম করে সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম এবং দেশসেবার পরিচয় রাখছেন, তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। পোশাকশ্রমিকেরা চোখ ধাঁধানো আলোর নিচে নিজেদের তারুণ্য-যৌবনের দিনগুলো কাটিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন। আর আমরা, সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি এই সব ঘামভেজানো রক্তমাখা টাকা নিয়ে নয়ছয় করছি। সরকারি প্রকল্প তৈরি করছি টাকা লুটের জন্য। সরকারি বরাদ্দ দেখলেই বাঘের থাবা বসিয়ে সিংহভাগ সরানোর চেষ্টা করছি।

২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, মেক্সিকোর ভূমিকম্পের ক্ষতির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক নিয়ে এক গবেষণার ফল ছিল প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য। বলা হয়েছে, ‘মেক্সিকোর ২০১৭ সালের ভূমিকম্পে যেসব ভবন ধসে পড়েছে, সেসব আসলে ভূমিকম্পে ধসেনি, ধসেছে দুর্নীতির কারণে।’ দুর্নীতির কারণে নিয়মকানুন এড়িয়ে ত্রুটিপূর্ণভাবে ভবনগুলো নির্মিত হতে পেরেছিল। বাংলাদেশেও রানা প্লাজা ধসেছে বৃষ্টির কারণে নয়, দুর্নীতির কারণে। বনানীর ভবনে আগুন লেগেছে, তারও কারণ ওই দুর্নীতি। এখানে লঞ্চ ডুবে মানুষ মারা যায়, কারণ দুর্নীতি। এখানে মশার কামড়ে প্রায়-মহামারি হয়, এর কারণও দুর্নীতিই।

আর দুর্নীতির কারণেই এই দেশে ভয়াবহ বেকারত্বের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। টাকা লুট হচ্ছে, সেই টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে; ফলে দেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অর্থনীতিতে আরেক নতুন ধাঁধা দেখা দিয়েছে: প্রবৃদ্ধি আছে, কিন্তু বেকারত্ব বাড়ছে কেন? কাজের সুযোগ কেন সৃষ্টি হচ্ছে না? দুর্নীতির কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কোটি কোটি টাকা কোনো একটা কলকারখানার নামে ঋণ নিয়ে যিনি শোধ করছেন না, তিনি তো আসলে সেই টাকা দেশে বিনিয়োগ করেননি, বিদেশে পাচার করেছেন; ফলে কর্মসংস্থান হবে কী করে?

দুর্নীতির দাবানলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশে টাকা পাচার। তার কারণও দুর্নীতি। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দুর্নীতিবাজ নেতা বা কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ী বা লুটেরা কেন দেশে রাখবেন? বিদেশে পাঠালেই সর্ব কূল রক্ষা। ফলে দেশি ব্যাংকের ওপর চাপ পড়ছে। সরকারকে বার্ষিক বাজেটের সংস্থান করতে নতুন নতুন টাকার উৎসের সন্ধান করতে হচ্ছে।

এই অবস্থা চলতে দেওয়া উচিত নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রাণপণ প্রয়াস, পরিশ্রম, সৃজনশীলতা ভেস্তে যেতে বসেছে অল্প কিছু মানুষের দুর্নীতি, লুট, টাকা পাচারের কারণে। এটা চলতে দেওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাকমার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যাঁরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ।’

অতি অল্পসংখ্যক মানুষের জন্য ১৭ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ আজ ধূলিসাৎ হতে বসেছে। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অতীতে দুর্নীতি হয়েছে সত্য, কিন্তু আমরা এখন খাদের কিনারে চলে এসেছি। এখান থেকে যদি সরে না আসি, অতল খাদে পড়ে যাব, আর উঠতে পারব না।

এই মুহূর্তটাই শ্রেষ্ঠ সময়। আজ থেকেই শুরু করুন দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকবার বলেছেন। এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অ্যাকশন ওপর থেকে শুরু করতে হবে। এই কাজে বাধা আসবে, আশপাশের মানুষেরাই বিরাগ দেখাবেন; কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষ, যাঁরা সবচেয়ে কম পেয়ে দেশকে সবচেয়ে বেশি দেন, তাঁরা খুশি হবেন, তাঁরা উপকৃত হবেন।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করে বহু বছরের সংগ্রামের পর এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে আমরা কতিপয় দুর্নীতিবাজের রাহুগ্রাসে দেশের ভবিষ্যৎকে বিসর্জন দিতে পারি না। দেশকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতেই হবে। তাহলেই কেবল উন্নয়নের সুফল দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছাবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক