Thank you for trying Sticky AMP!!

দেউলিয়া ঝুঁকি ও সম্পূর্ণ বাংলাদেশীয় 'বেইল আউট' সমাচার

ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার ২০১০-১১ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। চলতি সপ্তাহের খবর, কয়েকটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক সম্প্রতি সরকারের কাছে আবারও মূলধনসংকট মোকাবিলায় ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন বরাদ্দকৃত ঋণ উদ্ধার করতে না পেরে টিকে থাকার জন্য বেইল আউট চাইছে।

প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, বেইল আউট কী? সহজভাবে বলা যায়, বেইল আউট হচ্ছে দেনার দায়ে বা মূলধনসংকটে পড়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তরফে আর্থিক সহায়তা করা। তবে রাষ্ট্রকেও অনেক সময় জাতীয় ব্যয় নির্বাহে বেইল আউটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থ ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা করার উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে কয়েকটি রাষ্ট্রকে বেইল আউটের মাধ্যমে সহায়তা করার উদাহরণ আমরা ইউরোপে দেখেছি।

গত এক দশকে বিশ্ব অর্থনৈতিক খাত বা রাজনীতিতে খুব প্রচলিত শব্দ হচ্ছে ‘বেইল আউট’। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যম, একাডেমিক সেক্টর বা পার্লামেন্ট, সব জায়গাতেই বেইল আউট ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়বস্তু। এই বেইল আউট এখন বাংলাদেশেও পৌঁছেছে। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ বিতরণের কারণে মূলধনসংকটে পতিত হয়েছে বাংলাদেশের কিছু ব্যাংক। খবরে প্রকাশ, সরকার ইতিমধ্যেই একদফা ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো আবারও আর্থিক সহায়তা চেয়েছে। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ বিতরণ করে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংক সংকটে পড়েছে। এমনও খবর পাওয়া যাচ্ছে, গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা এই ঋণ কতটা বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সেই বিনিয়োগ থেকে কর্মসংস্থান হয়েছে, না পাচার হয়ে গিয়েছে, সেটিও কেউ জানে না। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেন আর্থিক কেলেঙ্কারির এক প্রতিযোগিতা চলছে। হরহামেশাই নিত্যনতুন আর্থিক অনিয়মের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো আর্থিক মন্দা বা দেনার কারণ হচ্ছে কাঠামোগত ত্রুটি। ইউরোজোনের আর্থিক কাঠামোতে মোট দেশজ উৎপাদনের সঙ্গে ব্যয়ের আনুপাতিক গরমিল রোধের জন্য মাসট্রিক্ট চুক্তিতে কোনো বাধা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কেন রাখা হয়নি? হিসাব খুবই পরিষ্কার। ইউরোজোনের দুই প্রভাবশালী দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অন্যদের থেকে বেশি ব্যয় করে থাকে। বলা হয়ে থাকে, তাদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য বড়জোর ইইউ থেকে বের করে দেওয়া যেতে পারে। তবে এতে করে মুদ্রা হিসাবে ইউরো আরও দুর্বল হওয়ার শঙ্কা থাকে। যার ফলে উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে আয় ও ব্যয়ের মারাত্মক ব্যবধান দেখা দেয়, যা অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যায় দেশগুলোকে।

ইউরোজোনের কয়েকটি দেশের আর্থিক ঘাটতির আরেকটি কারণ ছিল নিম্ন সুদের হার। যার কারণে ইউরোভুক্ত দেশগুলোয় ইউরোর অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। তবে এই বিনিয়োগের বেশির ভাগই এসেছে জার্মানি ও ফ্রান্স থেকে। এই দুই দেশের সঙ্গে অন্যরা কুলিয়ে উঠতে পারেনি। দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতেই বেশির ভাগ বিনিয়োগ করা হয়েছে। স্বাভাবিক হিসাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতির উন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর বিদ্যমান আর্থিক ব্যবধানের কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেতন ও দ্রব্যমূল্যেরও বৃদ্ধি ঘটে। এই অবস্থাকে সামাল দিতে পারেনি ইউরোজোনের বেশ কিছু দেশ। যেমন: সাইপ্রাস, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, ইতালি ও পর্তুগাল। একদিকে যেমন তাদের রপ্তানি আয় হ্রাস পায়, রাজস্ব সংগ্রহ কমতে থাকে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের কৃচ্ছ্র সাধনে মনোযোগী হতে হয়। বেকার ভাতা হ্রাস করা হয়, পেনশন-সুবিধায় কাটছাঁট, বেতনও কমানো হয় বেশ কয়েকটি দেশে। কৃচ্ছ্র সাধনের জন্য তাদের ওপর ইইউয়ের পক্ষ থেকে চাপও ছিল। এর বিনিময়ে মন্দাক্রান্ত দেশগুলোয় দেওয়া হয় বেইল আউট তহবিল।

আগেই বলা হয়েছে, ইউরোপের ওই সংকটের কারণ ছিল ইউরোজোনের অর্থনীতির কাঠামোগত ত্রুটি, যা থেকে উত্তর ইউরোপের বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্স সুবিধা ভোগ করছিল। উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি, স্বল্প হারে সুদ ও উদার শ্রমবাজারের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল বা ইতালি।

ইউরোপ বা অন্যান্য দেশের বেইল আউটের সঙ্গে বাংলাদেশের এই বেইল আউটের কোনো সামঞ্জস্য নেই। ইউরোপে বেইল আউট সুবিধা দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। সেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানকে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তার উপকারভোগী হয়েছে জনসাধারণ। ইউরোপের ছিল বিভিন্ন দেশের মধ্যকার এক যৌথ ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা। আর বাংলাদেশে ব্যাংকগুলো যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার নির্জলা কারণ অনিয়ম। এটি বাংলাদেশের নিতান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। সোনালী ব্যাংক হলমার্ককে ঋণ দেওয়া ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এক টাকাও ফেরত পায়নি। জনতা ব্যাংক ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অ্যাননট্যাক্সকে। বেসিক ব্যাংকও ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে বলে খবরে দেখা গিয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকেরও ঋণ বিতরণে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা যায় যে এসব ব্যাংকে যে বেইল আউট দেওয়া হয়েছে বা হবে, সেটার সুবিধা পাবে অপরাধীরা, যারা ব্যাংকের মাধ্যমে জনসাধারণের টাকা লোপাট করেছে।

তাই অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে ইউরোপের বেইল আউট ও বাংলাদেশের বেইল আউটকে এক করে মিলিয়ে দেখা সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণও দিতে পারেন। সেখানেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বেইল আউটের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক মন্দা ও বেইল আউটের কারণে অর্থনীতির কাঠামোগত ত্রুটি। সরাসরি অনিয়ম বা দুর্নীতি নয়। ওই সব দেশেও অনিয়ম ও দুর্নীতি আছে।

তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো শেষ পর্যন্ত এক হরিলুটের আস্তানায় পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রকারান্তরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই নিজস্ব লোকদের হরিলুটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এটা দুনীতির একটা ভিন্ন মাত্রা। সরাসরি লুট না করে অন্যদের দিয়ে অনেকটা ডাকাতি করানোর মতো। এটি হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক ডাকাতি। জনগণের টাকায় এই দুর্নীতিবাজদের বেইল আউট সুবিধা দেওয়া কতটা সমীচীন, তা ভেবে দেখার বিষয়।

ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।